মধুপুরের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বিলুপ্তির পথে

নিজস্ব প্রতিনিধিঃ মাতৃভাষার বই ছাপানো হলেও অস্তিত্ব সংকটে পড়ে বিলুপ্তির পথে টাঙ্গাইলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষা। নিজস্ব ভাষা বিষয়ক শিক্ষকের অভাব যেমন রয়েছে, তেমনি বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে নিয়মিত চর্চা না থাকায় এই সংকট তৈরি হয়েছে বলে জানান ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নেতারা। মাতৃভাষার অপমৃত্যু ঠেকাতে সরকারের কার্যকর ভূমিকার আহ্বান জানান স্থানীয়রা।

বাংলাদেশে প্রায় ৫০টির মতো ভাষা প্রচলিত আছে। মধুপুর গড় এলাকায় ৩৫ শতাংশ গারো ও কোচ সম্প্রদায়ের, আর বাকি ৬৫ শতাংশ বাঙালি জনগোষ্ঠী মানুষের বসবাস। তার মধ্যে মধুপুরের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে মান্দি ভাষা বা আচিক ও কোচ ভাষা প্রচলিত আছে।

মনিসা ম্রং বলেন, ‘আমরা যখন ছোট ছিলাম, বাঙালিরা মধুপুর বনে আমাদের আশপাশে ছিল না। এখন কিন্তু অনেক বাঙালি চলে এসেছে। বাঙালি ছেলে মেয়েদের সঙ্গে আমাদের সন্তানরা স্কুলে যায় বা বিভিন্ন কারণে তাদের সঙ্গে মিশতে হয়। এসব কারণে আমাদের ভাষা বিলুপ্তির পথে।

অঞ্চলভিত্তিক কালচারাল বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের একাডেমি খোলার দাবি জানাচ্ছি। তাহলে সাংস্কৃতিক চর্চার পাশাপাশি আমাদের মান্দি ভাষার চর্চা থাকবে।’

স্কুল ছাত্রী সেংবিয়া রিছিল বলেন, ‘স্কুলে আমার ফ্রেন্ডস সার্কেল সব বাঙালি। সেখানের তেমন আমাদের ভাষার চর্চা হয় না। তবে বাড়িতে আমাদের ভাষার চর্চা হয়। পরিবার ও স্কুলে যদি আমাদের ভাষায় কথা বলতে পারতাম, তাহলে মান্দি ভাষার চর্চা থাকতো। অপরদিকে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে মাধ্যমিক বা কলেজে মান্দি ভাষার প্রচলন থাকলে আমাদের ভাষার অনেক উন্নতি হতো।’

অপর স্কুল ছাত্রী লামিসা রিছিল বলেন, ‘বড়দের কাছ থেকে শুনে শুনে একটু একটু বলার চেষ্টা করি। কিন্তু বড়রা না বললে আমরা আর বলতে পারি না। আমাদের আশপাশের বেশিরভাগ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে, কেউ আর মান্দিতে কথা বলে না। বই থাকলেও শিক্ষক না থাকার কারণে আমরা শিখতে পারছি না।’

গাছাবাড়ি মিশনারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা ঝুমুর আজীম বলেন, ‘আমাদের ভাষা বাড়িতে একটু হলেও ব্যবহার করছি। এ ছাড়া আমাদের সন্তানরা গান নাচসহ অনেক কিছুই মান্দি ভাষায় পারে না। অনেকেই শিখে না বা জানতে চায় না। আমি তেমন পারি না। আমার কাছ থেকে সন্তানরা আর কি শিখবে। মান্দি ভাষার বই তৈরি করা হলেও শিক্ষকের অভাবে পড়ানো সম্ভব হচ্ছে না।’

মধুপুর জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজেন নকরেক বলেন, ‘ঘর থেকে বের হলেই বাজার ঘাট অফিস আদালতে আমাদের বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে হয়। যে কারণে আমাদের ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। পৃষ্ঠপোষকতা বা চর্চার প্রয়োজন আছে। আমাদের অভিভাবকরা অসচেতন। পরিবারে যদি তারা ভাষা ব্যবহার করতো তাহলে একটু হলেও চর্চা থাকতো। প্রাথমিক পর্যায়ে আমাদের ভাষার বই ছাপানো হলেও এগুলো আর ব্যবহার হচ্ছে না। শিক্ষক না থাকার কারণে ব্যবহার করা হচ্ছে না। চর্চার মাধ্যমে সংরক্ষণ করা সম্ভব।’

তিনি আরও বলেন, সংগঠনের পক্ষ থেকে ২০০৮ সালে গড় এলাকায় ১২টি স্কুল চালু করা হয়েছিল। যেখানে গারো শিশুদের আচিক ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হতো। কিন্তু তিন বছর চলার পর দাতা সংস্থার অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় তা বন্ধ হয়ে যায়। ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষা নীতিমালায় শিশুদের তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত মাতৃভাষায় শিক্ষা ব্যবস্থা চালুর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে আগামী প্রজন্ম আচিক ভাষা নিয়ে শঙ্কায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এ বিভাগের আরো সংবাদ
Share via
Copy link
Powered by Social Snap