নিজস্ব প্রতিনিধিঃ টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার চার ভাগের তিন ভাগই বনভূমি দ্বারা বেষ্টিত। ঘাটাইলের বনাঞ্চল শাল-গজারির বন হিসেবে খ্যাত মধুপুর গড় এলাকার একটি অংশ। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা এ বনে শাল-গজারির পাশাপাশি ছিল আমলকি, হরিতকি, বহেড়া, অর্জুন, আনাইগোটা, বট, শিমুল, ছাগলনাদি, চুকাইগোটা, জয়নাগোটাসহ নানা প্রজাতির গাছ। এ ছাড়া বনে দেখা মিলতো মেছোবাঘ, বাগডাশ, বুনো শূকর, হাতি, বানর, সজারুসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী। এ ছাড়াও প্রায় অর্ধশত প্রজাতির পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত থাকতো বন। এখন পুরো বন ঘুরেও দেখা মিলবে না প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা কোনো প্রাচীন গাছ।
বন বিভাগে কর্মরত কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে রাষ্ট্রীয় এই সম্পদ হরিলুট হচ্ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, স্থানীয় প্রশাসন ও বন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এলাকার প্রভাবশালীরা এসব কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ, ১৯২৭ সালের সংশোধিত বন আইন এবং ২০১২ সালের বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ আইনে সংরক্ষিত বনে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ, ফল, সবজির বাগান কিংবা ব্যক্তিগত কাজে এই বনভূমি পরিচালনা না করার নির্দেশ রয়েছে। কে মানে কার কথা। দিনের বেলায়ও প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা শাল ও গজারি গাছ কেটে প্রায় দুই শতাধিক বনের ভেতরে ও আশপাশের করাত কলে চিরিয়ে দেদারছে বিক্রি করে দিচ্ছে। আর এসবের জন্য দায়ী বনের রক্ষক নামে ভক্ষক অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। যেন দেখার কেউ নেই। অথচ টাঙ্গাইলের মানুষ এক সময় গর্ভের সঙ্গে বলতো ‘নদী চর খাল বিল গজারির বন, টাঙ্গাইল শাড়ি তার গর্বের ধন।’ ‘চমচম, টমটম আরও আছে শাড়ি, এই তিনে মিলেমিশে একাকার টাঙ্গাইলের বাড়ি’। এমন প্রবাদ ছিল মানুষের ?মুখে মুখে। নানা কারণেই টাঙ্গাইলের প্রসিদ্ধি রয়েছে।
তার মধ্যে অন্যতম প্রাকৃতিক বন। তবে সেটি এখন হুমকিতে। একসময় শাল-গজারিসহ নানা প্রজাতির দেশীয় গাছে আচ্ছাদিত ছিল টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার বনাঞ্চল। স্থানীয়দের অভিযোগ, সামাজিক বনায়নের নামে কৃত্রিম বনায়ন সৃষ্টি করে ধ্বংস করা হয়েছে সেই প্রাকৃতিক বন। পরিবেশবিদদের দাবি, প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে কৃত্রিম বনায়ন করা হলে পরিবেশ তার ভারসাম্য হারাবে।
বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় বনভূমির পরিমাণ ২৫ হাজার ৭১১ একর। তিন দশক আগেও এই বনাঞ্চলটি ছিল শাল-গজারিসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাকৃতিক গাছপালায় ঘেরা ঘন জঙ্গল। ১৯৮৪ সালের দিকে এ অঞ্চলে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি শুরু হয়, যা এখনো চলছে। এ বছরও ঘাটাইল বন বিভাগের আওতায় ৯৩ একর জমিতে সামাজিক বনায়ন করা হয়েছে। সামাজিক বনায়ন হওয়ার পর থেকেই শুরু হয় প্রাকৃতিক বন ধ্বংসের কার্যক্রম। বনের অধিবাসীরা জানান, সামাজিক বনায়নের কারণে প্রাকৃতিক বনের অন্যান্য গাছের সঙ্গে বিলুপ্তির পথে সংরক্ষিত বনের শাল-গজারি গাছ। বনের কিছু কিছু অংশে এখনো শাল-গজারি দেখা গেলেও আগামী ১৫-২০ বছর পর বিলুপ্ত হতে পারে শাল-গজারি গাছ। শুধু বৃক্ষই নয়, বন থেকে হারিয়ে গেছে নানা ধরনের বন্যপ্রাণী ও বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখি।
গারোবাজার এলাকার স্কুল শিক্ষক সাজ্জাদ রহমান বলেন, তিন যুগ আগেও বন্যপ্রাণীর ছোটাছুটি আর পাখির কলকাকলিতে মুখর ছিল এ বনাঞ্চল।’ তার মতে, বনবিভাগের সামাজিক বনায়ন কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকেই বিলুপ্ত হওয়া শুরু করে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও প্রাণীর।
বন এলাকার বাসিন্দা কলেজ শিক্ষক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সামাজিক বনায়নের সিদ্ধান্তটি সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। এ প্রকল্পের মাধ্যমে বন সংরক্ষণের পরিবর্তে প্রাকৃতিক বনকে বিনাশ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বনকে সৃজন নয়, বনকে বনের মতো বেড়ে উঠতে দেয়া উচিত।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) বিভাগীয় সমন্বয়কারী গৌতম চন্দ্র চন্দ বলেন, ‘দেশীয় প্রজাতির গাছ পরিবেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে চলতে থাকলে একদিন শাল-গজারিসহ দেশীয় প্রজাতির গাছ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তাই প্রাকৃতিকভাবে গজানো শাল-গজারি গাছগুলো কীভাবে সংরক্ষণ করা যায় সেই পরিকল্পনা করা উচিত।
এ বিষয়ে বন বিভাগের ধলাপাড়া রেঞ্জের কর্মকর্তা ওয়াদুদুর রহমান বলেন, ‘সামাজিক বনায়নের কারণে প্রাকৃতিক বনের কোনো ক্ষতি হয় না। বন বিভাগের পতিত জমিতেই সামাজিক বনায়ন করা হয়। এতে শাল বনেরও ক্ষতি হয় না।’