দেখতে দেখতে কেটে গেল ২৯ বছর। তবু চোখের পলক ফেললে মনে হয় এই তো সেদিন। ১৯৯৬ সালের ১৩ মে বিকেলের ভয়ার্ত স্মৃতি ভেসে ওঠে মানসপটে। এত বছর পরও টাঙ্গাইলের মানুষ ভুলতে পারেনি ভয়াল ১৩ মের টর্নেডোর সেই তাণ্ডবের স্মৃতি।
দেখতে দেখতে কেটে গেল ২৯ বছর। তবু চোখের পলক ফেললে মনে হয় এই তো সেদিন। ১৯৯৬ সালের ১৩ মে বিকেলের ভয়ার্ত স্মৃতি ভেসে ওঠে মানসপটে। এত বছর পরও টাঙ্গাইলের মানুষ ভুলতে পারেনি ভয়াল ১৩ মের টর্নেডোর সেই তাণ্ডবের স্মৃতি।
সেদিন বিকেলে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে মুহূর্তের মধ্যে জেলার গোপালপুর, কালিহাতী, বাসাইল, ঘাটাইল ও সখীপুর এ পাঁচটি উপজেলার ৪০টি গ্রাম লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। অনেকের ঘরের চালা উড়ে যাওয়ায় গোলার ধান ঝড়ে অদৃশ্য হতে দেখা যায়।
ওই দিনই বিকেল সোয়া ৫টার দিকে কালিহাতী উপজেলার তাঁতসমৃদ্ধ এলাকা রামপুর-কুকরাইল গ্রামে টর্নেডো আঘাত হানে। রামপুর ও কুকরাইল গ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে ওই দুই গ্রামের একই পরিবারের ৭ জনসহ ১০৫ জন নারী-পুরুষ ও শিশু নিহত এবং ৪ শতাধিক মানুষ আহত হয়। রামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে গণকবরে একত্রে দাফন করা হয় ৭৭ জনের মরদেহ।
বাসাইলের মিরিকপুরে ধানকাটার মৌসুম থাকায় উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলার ধান কাটা শ্রমিক সমবেত হয়েছিল এ অঞ্চলে। ঝড় থেকে রক্ষা পেতেমিরিকপুর-সৈদামপুরের ধানক্ষেতের আতঙ্কগ্রস্ত বহু শ্রমিক মিরিকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ভবনে আশ্রয় নিয়েছিল। সেদিন বিকেল ৫টা ২০ মিনিটের দিকে উত্তর দিক থেকে ধেয়ে আসা স্বল্প সময়ের টর্নেডোর ছোবলে স্কুলভবনটি বিধ্বস্ত হওয়ায় তারা সেখানেই চাপা পড়ে মারা যায়। গ্রামের বহু লোক নিখোঁজ হয়। পরদিন তাদের মৃতদেহের খোঁজ মেলে পাশের নদী, পুকুর, খাল-বিল ও জলাশয়ে।
মৃত মানুষ, গবাদি পশু ও মাছের দুর্গন্ধে বাসাইলের বাতাস সেদিন ভারী হয়ে গিয়েছিল। মিরিকপুর ছাড়াও ওই উপজেলার বর্নীকিশোরী, হান্দুলিপাড়া, কলিয়া, কাউলজানী, খাটরা, ফুলকী, বাদিয়াজান, সুন্নাগ্রামের অংশবিশেষ মারাত্মক ভাবে আক্রান্ত হয়। বর্নীকিশোরী উত্তরপাড়ার এক পরিবারের মরদেহ প্রায় আধমাইল দূরের বিল থেকে উদ্ধার করা হয়। অনেক পরিবারের কেউই জীবিত ছিলনা।
বাসাইল উপজেলা হাসপাতালসহ পাশের হাসপাতালগুলো ছিন্নভিন্ন আহত লোকজনে ভরে গিয়েছিল। উপজেলায় টর্নেডো আক্রান্ত এলাকায় একাধিক গণকবর তৈরি করা হয়েছিল। ঘূর্ণিঝড়ে বাসাইল উপজেলার ১৭ গ্রামের ৫ হাজার পরিবারের প্রায়সাড়ে ২৫ হাজার লোক ক্ষতিগ্রস্তহয়। ৩ হাজার ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ রূপে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ২০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ৫-৬টি কাঁচাবাজার, প্রায় দুই হাজার গবাদিপশু, ১০ হাজারহাঁস-মুরগি, সাড়ে ৩০০ টিউবওয়েল ও ২৫ হাজারগাছ ক্ষতিগ্রস্তহয়।
সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ২৩৭ জনে দাঁড়ায়। তবে বেসরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যাছিল আরও অনেক বেশি। আজও কালো মেঘের আনাগোনা দেখলে বাসাইলের মানুষের মনে ভেসে ওঠে মিরিকপুরের সেইঘূর্ণিঝড়ের আতঙ্কিত স্মৃতি।
টাঙ্গাইলের ৪০টি গ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সেদিনের টর্নেডোর আঘাতে মারা যায় অসংখ্য গবাদি পশু, দুমড়ে-মুচড়ে যায় ঘরবাড়ি, বিরানভূমিতে পরিণত হয় ফসলের মাঠ। সেই ৫ মিনিটের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় (টর্নেডো) টাঙ্গাইল জেলার বৃহদাংশের সবকিছু ধ্বংস করে দেয়। ওই সময় বিভিন্ন সমাজ সেবামূলক সংগঠন ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে এগিয়ে আসেন। সেদিনের টর্নেডোর আঘাতে অনেকেই পঙ্গুত্বকে বরণ করে আজও বেঁচে আছেন।
টর্নেডোয় প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের স্মরণে স্ব স্ব এলাকায় স্থানীয় সামাজিক সংগঠনগুলোর উদ্যোগে প্রতিবছর দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এই দিনটিকে স্মরণ করে কালিহাতীর রামপুর-কুকরাইল গ্রামের স্বজন হারানো পরিবারগুলো প্রতিবছর কাঙালিভোজ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করে থাকে। মসজিদে মসজিদে করা হয় বিশেষ মোনাজাত। এবারও দিনব্যাপী অনুরূপ আয়োজন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে টাঙ্গাইলের বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক রাশেদ রহমান বলেন, ‘১৯৯৬ সালের ১৩ মের ভয়ালচিত্র চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। ক্ষতিগ্রস্তরা আজও সেই তাণ্ডবের কথা স্মরণ করে শিউরে উঠেন। টাঙ্গাইলে ইতিহাসে এ রকম দুর্যোগ আসেনি কোনো দিন। দিনটি শোকে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’