নিজস্ব প্রতিনিধিঃ টানা ৯৪ বছর ধরে অবিরত কোরআন তেলাওয়াত চলছে ৭০০ বছরের পুরনো টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি নওয়াব শাহী মসজিদে। ব্যাপারটি বিস্ময়কর হলেও এমনই কার্যক্রম চলছে সেখানে। ১৯২৯ সাল থেকে শুরু হওয়া কোরআন তেলাওয়াত নিয়মতান্ত্রিকভাবে চলছে ২৪ ঘণ্টাই। এক মিনিটের জন্যও বন্ধ হয়নি তেলাওয়াত। মুক্তিযুদ্ধকালে চলছে এ কার্যক্রম। কর্তৃপক্ষের নিযুক্ত পাঁচজন কোরআনে হাফেজ মসজিদ কম্পাউন্ডের একটি কক্ষে ধারাবাহিকভাবে কোরআন তেলাওয়াত করে থাকেন।
১৯২৯ সালের ১৭ এপ্রিল ৬৫ বছর বয়সে তিনি মারা গেলে নিজ বাড়ির মসজিদ চত্বরে সমাহিত করা হয় তাকে। সেই সময় থেকেই তার কবরের পাশে বসে এই তেলাওয়াত চলছে। নওয়াব চৌধুরীর কবরের পাশে ৯৪ বছর ধরে চলছে কোরআন তেলাওয়াত।
নওয়াব আলী চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম একজন। অবিভক্ত বাংলার প্রথম মুসলিম মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি।
উইকিপিডিয়ায় সূত্রে জানা যায়, ১৯১১ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকার কার্জন হলে ল্যান্সলট হেয়ারের বিদায় এবং চার্লস বেইলির যোগদান উপলক্ষে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে পৃথক দুইটি মানপত্রে নবাব সলিমুল্লাহ ও নওয়াব আলী চৌধুরী ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানান।
১৯১৭ সালের ৭ মার্চ ইম্পেরিয়াল কাউন্সিলের সভায় তিনি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি উপস্থাপন করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালে অর্থাভাব দেখা দিলে তিনি নিজ জমিদারির একাংশ বন্ধক রেখে এককালীন ৩৫ হাজার টাকা দেন।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর শিক্ষার্থীদের বৃত্তি বাবদ ১৬ হাজার টাকার একটি তহবিল নওয়াব আলী চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ে দেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সিনেট ভবনের নাম ‘সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন’ নামকরণ করেন। নওয়াব আলী চৌধুরী ১৯২৯ সালের ১৭ এপ্রিল ৬৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
ধনবাড়ী নওয়াব জামে মসজিদের পেশ ইমাম মওলানা মুফতি ইদ্রিস হোসাইন জানান, মৃত্যুর আগেই নওয়াব আলী চৌধুরী মসজিদের কাছে তার কবরের জায়গা নির্ধারন করেন। প্রতিদিন ৫ জন হাফেজ কোরআন তেলাওয়তের দায়িত্বে থাকেন। তারা পালাক্রমে তেলাওয়াত করেন।
সকাল ছয়টা থেকে সাড়ে আটটা, সাড়ে আটটা থেকে বেলা ১১টা, বেলা ১১টা থেকে দুপুর দেড়টা, দুপুর দেড়টা থেকে বিকেল চারটা এবং বিকেল চারটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা। এভাবে আবার রাতের পালা করে শুরু হয়। একেক শিফটে (পালা) একেকজন কোরআন পাঠের দায়িত্ব থাকেন।
বর্তমানে হাফেজ আব্দুস সামাদ ছাড়াও মো. কামরুজ্জামান, আবু হানিফ ও হেদায়েত হোসেন এবং মো. ওয়ারেজ আলী নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াতের জন্য নিয়োজিত রয়েছেন। এরা কেউ অসুস্থ হলে অথবা ছুটিতে বাড়িতে গেলে মসজিদের পাশেই হিফজখানা থেকে ছাত্রদের দিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করা হয়।
তেলাওয়াতকারীরা এখানে কোরআন তেলাওয়াতের পাশাপাশি হিফজখানায় শিক্ষকতা করেন। আর সেখান থেকেই তাদের সম্মানী দেয়া হয়।
সরেজমিন দেখা যায়, নওয়াব আলীর কবরের পাশে একজন কোরআন তেলাওয়াত করছেন। দৃষ্টি নন্দন এই মসজিদটি দেখতে বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ আসছেন। মসজিদের পাশে তার কবরস্থানে চলছে অবিরাম কোরআন তেলাওয়াত।
জানা গেছে, সেলজুক তুর্কি বংশের ইসপিঞ্জার খাঁ ও মনোয়ার খাঁ নামে দুই ভাই ১৬ শতাব্দীতে ঐতিহ্যবাহী এককক্ষ বিশিষ্ট একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। জনশ্রুতি রয়েছে, সম্রাট আকবরের সময় এই দুই ভাই ধনবাড়ীর অত্যাচারী জমিদারকে পরাজিত করার পর এ অঞ্চলের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং এ মসজিদটি নির্মাণ করেন।
নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী প্রায় ১১৭ বছর আগে এ মসজিদটি সম্প্রসারণ করে আধুনিক রূপ দেন। তিনি বাংলাভাষার প্রথম প্রস্তাবক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও যুক্ত বাংলার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন।
সংস্কারের আগে মসজিদটির দৈর্ঘ্য ছিল ১৩ দশমিক ৭২ মিটার (৪৫ ফুট)। প্রস্থ ছিল ৪ দশমিক ৫৭ মিটার (১৫ ফুট)। পরবর্তীতে মসজিদটি বর্গাকৃতির ও তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মোগল স্থাপত্যের বৈসাদৃশ্যপূর্ণ করা হয়েছে। মোগল স্থাপত্য-রীতিতে তৈরি এই মসজিদের মোজাইকগুলো এবং মেঝের মার্বেল পাথরগুলো নিপুণভাবে কারুকার্যমণ্ডিত।
সংস্কারের কারণে প্রাচীনত্ব কিছুটা বিলীন হলেও মসজিদের সৌন্দর্য-শোভা অনেক বেড়েছে। মসজিদের ভেতরে ঢোকার জন্য পূর্ব দিকের বহু খাঁজে চিত্রিত তিনটি প্রবেশপথ, উত্তর ও দক্ষিণে আরও একটি করে সর্বমোট পাঁচটি প্রবেশ পথ রয়েছে।
প্রায় ১০ কাঠা জায়গায় নির্মিত মসজিদটির চর্তুদিক থেকে ৪টি প্রবেশ পথ এবং ৯টি জানালা এবং ৩৪টি ছোট ও বড় গম্বুজ রয়েছে। বড় ১০টি মিনারের প্রত্যেকটির উচ্চতা ছাদ থেকে প্রায় ৩০ ফুট উঁচু।
মসজিদের দোতলার মিনারটির উচ্চতা প্রায় ১৫ ফুট। ৫ ফুট উচ্চতা এবং ৩ ফুট প্রস্থের মিহরাবটি দেখতে বেশ আকর্ষণীয় এবং দৃষ্টিনন্দন। মসজিদের মেঝে ও দেয়াল কাঁচের টুকরো দিয়ে নকশা ও মোজাইক করা। ভেতরের পুরো অংশ জুড়ে চীনা মাটির টুকরো দিয়ে অধিকাংশ স্থানে ফুলের নকশা করা হয়েছে।
৩০ ফুট উচ্চতার মিনারের মাথায় স্থাপিত ১০টি তামার চাঁদ মিনারের সৌন্দর্য্য কয়েকগুণ করেছে। মসজিদে ১৮টি হাড়িবাতি সংরক্ষিত রয়েছে। যেগুলো শুরুর যুগে নারিকেল তেলের মাধ্যমে আলো জ্বালানোর কাজে ব্যবহার করা হতো। মোগল আমলে ব্যবহৃত ৩টি ঝাড়বাতিও রয়েছে। সুপ্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদে একসঙ্গে ২০০ মুসল্লির নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা রয়েছে।
মসজিদের পাশেই রয়েছে শান বাঁধানো ঘাট ও কবরস্থান। যেখানে দাফন করা হয়েছে নওয়াব বাহাদুর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীকে। তার ওয়াকফকৃত সম্পদের মাধ্যমে মসজিদ, মাদরাসা ও ঈদগাহ পরিচালিত হয়।
পূর্বদিকের তিনটি প্রবেশপথ বরাবর পশ্চিমের দেয়ালে ৩টি মিহরাব রয়েছে। কেন্দ্রীয় মিহরাবটির অষ্টভুজাকারের, দুই পাশে রয়েছে বহু খাঁজবিশিষ্ট খিলান। তাছাড়াও সেটিতে ফুলের রকমারি নকশা রয়েছে। অন্য দু’টি মিহরাবও বহু খাঁজবিশিষ্ট তবে কারুকার্যহীন খিলানযোগে গঠিত।
প্রায় ৩০ বিঘা জমির ওপর শান বাঁধানো ঘাটের বিশাল একটি দীঘি রয়েছে। তাতে মুসল্লিরা ওজু করেন। তাছাড়াও মসজিদের আশপাশে সুপ্রশস্ত ও খোলামেলা অনেক জায়গা রয়েছে। যা দর্শনার্থীদের মনে বাড়তি আকর্ষণ সৃষ্টি করে।
এদিকে দূরদূরান্ত থেকে শত শত নারী-পুরুষ আসে মসজিদ ও কোরআন তেলাওয়াত দেখতে। মসজিদে মানত করেন অনেকেই।
ধনবাড়ী নওয়াব শাহী জামে মসজিদের খতিব ও ইমাম হাফেজ মাওলানা ইদ্রিস হুসাইন জানিয়েছেন, এখানে নামাজের সময় ছাড়া পালাক্রমে ৫ জন হাফেজ সার্বক্ষণিক কোরআন তেলাওয়াত করেন। পুকুরের মাছ বিক্রি ও জমি থেকে আয়ের অর্থেই মসজিদ সংশ্লিষ্টদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
ধনবাড়ী এলাকার মুক্তাদির মো. আ. সামাদ ও আছেদ আলী জানান, ধনবাড়ীর এই নওয়াব আলী চৌধুরীর কবরের পাশে অবিরাম কোরআন তেলাওয়াতের বিষয়টি দেখতে অনেকেই দূর-দুরান্ত হতে আসেন।
মসজিদের একজন মুসল্লি জানান, আমার বয়স এখন ৫৬। আমি আমার জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখি এখানে কোরআন পাঠ চলছে। আমার বাবাও এটাই দেখেছেন বলে জানিয়েছেন আমাকে।
ওই এলাকার প্রবীণ ব্যক্তি মো. রুহুল আমিন জানান, তিনি ছোটবেলা থেকেই এই কোরআন পাঠ দেখে আসছেন। এটি কোনো দিন বন্ধ হয়নি। নবাব নওয়াব আলীর ১৯০৩ সালে তার সব সম্পত্তি ‘নওয়াব আলী খোদা বক্স ধনবাড়ী ওয়াক্ফ এস্টেট’ নামে ওয়াক্ফ করে দেন।
নওয়াব আলী চৌধুরীর নাতনি জামাই আকবর উদ্দিন আহমেদ জানান, মৃত্যুর আগে নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী তার কবরের জন্য যে জায়গা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়েছে এবং তার ইচ্ছা অনুযায়ী এই কোরআন পাঠ চলছে। এটি ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।
Leave a Reply