মধুপুর বনের ভেষজ উদ্যান মালবিকার সুফল পাচ্ছে স্থানীয়রা

বিশেষ প্রতিনিধিঃ টাঙ্গাইলের লাল মাটির পাহাড় বিশাল শালবন বেষ্টিত মধুপুর গড়াঞ্চল। এ বনে একসময় নানা বৃক্ষের সমাহার ছিল। অভাব ছিল না ভেষজ (ঔষুধী গাছের) উদ্ভিদের। শাল, গজারী, সেগুন, বহেরা, গাদিলা, গামারী, পিতরাজ, বানরনরী, কানাইডিঙ্গা, আমলকি, আনাইগোটা, ভাটি ফুল সহ ভেষজ উদ্ভিদে ভরপুর ছিল। বন্য প্রাণীদের অভয়ারণ্য ছিল এই বন। নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী গারোদের অন্যতম হরেক রকম খাবারের বৈচিত্র্য ছিল এ বনে।

গারো সম্প্রদায়ের লোকেরা এ বন থেকে আলু সংগ্রহ করে খাদ্যের জোগান পেতো। গড়াঞ্চলের কবিরাজরা এ বন থেকে নানা ভেষজ উদ্ভিদ সংগ্রহ করে রোগীর সেবা করত। রোগ থেকে আরোগ্য পেতো এ অঞ্চলের মানুষেরা। যুগ যুগ ধরে এ এলাকার বসবাসরত মানুষেরা আধুনিক চিকিৎসার আগে ভেষজ চিকিৎসা নিতো। কালের পরিক্রমায় ধীরে ধীরে বসতি বাড়ার ফলে সঙ্কুচিত হতে থাকে বন।

এ কারণে কমতে থাকে ভেষজ উদ্ভিদ। ভেষজ চিকিৎসার কাজে ভেষজ বৃক্ষাদি অপরিহার্য। নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ভেষজ চিকিৎসার দিকে খেয়াল রেখে বিলুপ্ত প্রায় ভেষজ উদ্ভিদের বাগান সৃজন করেন টাঙ্গাইল বন বিভাগ।

টাঙ্গাইল বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, মধুপুর গড়াঞ্চলে বসবাসরত উপজাতীদের ভেষজ চিকিৎসার চাহিদা মেটাতে বিলুপ্ত প্রায় ভেষজ উদ্ভিদের উৎপাদন বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের জন্য ২০০৩ সালের ৪ জুলাই মধুপুরের চাড়ালজানী রেঞ্জের বেরীবাইদ মৌজার জলছত্র এলাকায় করা হয় ভেষজ উদ্যান। টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে গড়ে তোলা এ বাগানের নাম দেওয়া হয়েছে ভেষজ উদ্যান মালবিকা।

ভেষজ উদ্যানে ২০০২-২০০৩ সালে করা হয়  ৩হেক্টর জমিতে। উদ্যানের গাছ বৃদ্ধি ও গাছের অবস্থা ভাল হওয়ায় ২০০৩-২০০৪ সালে ৪ হেক্টর জমিতে ভেষজ গাছ লাগানো হয়। এ ভাবে ২০০৪-২০০৫ সালে ৬ হেক্টর ও ২০০৫-২০০৬ সালে ৭ হেক্টর ভেষজ বাগান করা হয়। সব মিলিয়ে ২০ হেক্টর জমিতে গড়ে উঠেছে এ ভেষজ উদ্যান।

এ উদ্যানের ভেষজ উদ্ভিদের মধ্যে আমলকি, হরিতকি, বহেরা, নিম, অর্জুন, নিশিন্দা, মহুয়া, নাগেশ্বর, উলুটকম্বল , বকুল, সোনালু, চন্দন,আগর, আমড়া, জলপাই, খাড়াজড়া, পিতরাজ, পেয়ারা, জাম, তেতুল, বেল, কালমেঘ, বাসক, হাতিশুর, চম্পাফুল, পিপুল,আকন্দ, ঘৃতকাঞ্চন, কেউকলা, মেহেদী, নয়নতারা, শতমূল, চাপালিশ, অশোক, শেফালী, চালতা, সর্পগন্ধা, পাথরকুচি, তুলসি, ধুতরা, তেজপাতা, জাম্বুরা, ঢাকি জাম, কুম্বি, ঢেউয়া, গর্জন, হৈমন্তী, কণ্যারী, পুত্রঞ্জীব, গোলাপ জাম, দুধক্রুচ, আতা, কদবেল, কামরাঙ্গা, বার্মাশিমূল, লটকন, কালেন্ড্রা, সিভিট,কানাইডিঙ্গা, পান, খয়ের, অনন্তমূল, গন্ধাসাগর, আগুনসর, নীলমনি, অড়হড়, প্রভৃতি। এ অর্থবছরে সৃজিত ভেষজ বাগান পরিপক্ক বাগানে রূপ নেয়।

সরজমিনে চাড়ালজানি রেঞ্জের মালবিকা ভেষজ উদ্যানে গিয়ে দেখা যায়, টাঙ্গাইল- ময়মনসিংহ মহাসড়কের পূর্ব পাশে এ মালবিকা ভেষজ উদ্যান। মধুপুরের লাল মাটিতে এ উদ্যানে নানা ভেষজ বৃক্ষে সজ্জিত। সবুজ শ্যামলে ভরা। হরেক প্রজাতির ভেষজের কারণে উদ্যানে গুনাগুণ ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেয়েছে। ভেষজ বৃক্ষগুলো বড় বড় হয়েছে। বৃক্ষগুলো ফুলও ফল দেয়া শুরু করেছে। উদ্যানে প্লট আকারে প্রজাতি ভেদে বাগান করা হয়েছে। ফলে স্থানীয়রা সুবিধা পাচ্ছে।

স্থানীয়রা জানান, তারা এ উদ্যানের ফুল, ফল লতা, পাতা, ছাল, বাকল প্রভৃতি নিয়ে কবিরাজি ঔষধ তৈরি করে খাচ্ছে। এছাড়াও আশপাশের উপজেলার মানুষেরা এ বাগানের সুবিধা নিতে ছুটে আসে। অনেকে আবার বীজ সংগ্রহ করে জাত সংরক্ষণ করছে। এভাবে স্থানীয় জনগণ ও কবিরাজরা মালবিকার সুফল পাচ্ছে বলে জানালেন অনেকেই।

টাঙ্গাইলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদুজ্জামান জানান, ভেষজ ঔষধ কবিরাজদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভেষজ চিকিৎসায় কোন পাশ্বপ্রতিক্রিয়া নাই। বিষমুক্ত ও প্রাকৃতিক ভাবে ভেষজ উৎপাদিত হয় মধুপুরে সৃজিত “মালবিকা” ভেষজ উদ্যানে। এ বাগানের ফলে এ এলাকার মানুষেরা উপকৃত হচ্ছে। এ বাগান সংরক্ষিত থাকলে যুগ যুগ ধরে এ এলাকার মানুষেরা এর সুফল পাবে। ভেষজ বাগানের গুনাগুণ আবহাওয়ার সাথে মিশে স্বাস্থ্যের জন্য উপকার বয়ে আনে। তিনি আরও জানান, চাড়ালজানী রেঞ্জের আয়তন ৫৮৮০.৪৬ হেক্টর।

প্রাকৃতিক, সামাজিক, ভেষজ উদ্যান ছাড়াও বেত, বাঁশ, উডলট, আগর ও শাল কপিস রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এ বিভাগের আরো সংবাদ
Share via
Copy link
Powered by Social Snap