নিজস্ব প্রতিনিধিঃ প্রকাশ্য দিবালোকে একটি হত্যা মামলার সাক্ষ্য দেওয়ায় খুনি চক্রের রোষানলে পড়ে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর মাসুদ রানা ‘প্রাণভয়ে বাড়ি ছেড়ে’ পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘরে একাধিকবার হামলা, ভাঙচুর ও সাজানো মামলায় হয়রানি করছেন। জীবননাশের আশঙ্কায় তিনি এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এমনটিই জানিয়েছেন ভুক্তভোগী মাসুদ রানা।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৮ সালের ১৮ এপ্রিল জমিসংক্রান্ত বিরোধে খুন হন ধনবাড়ী উপজেলার চাতুটিয়া গ্রামের নজর আলীর পুত্র আব্দুল কাদের। খুনের ঘটনায় একই গ্রামের বাসিন্দা এবং আমেরিকা প্রবাসী ডা. আলতাফ হোসেনসহ ৩৫ জনকে আসামি করে ধনবাড়ী থানায় মামলা হয়। ওই সালের ২ সেপ্টেম্বর থানা পুলিশ ২০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে আদালতে চার্জশিট দেয়। এ হত্যা মামলায় প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন পৌর কাউন্সিলর এবং বিলাসপুর গ্রামের মৃত কলিমউদ্দীনের পুত্র মাসুদ রানা।
মাসুদ রানা পুলিশ প্রশাসনসহ বিভিন্ন স্থানে লিখিত অভিযোগে জানান, খুনের ঘটনায় সাক্ষ্য না দেওয়ার জন্য ডাক্তার আলতাফ তাকে কয়েকবার সতর্ক করেন। কিন্তু ভয়ভীতি উপেক্ষা করে খুনের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে পুলিশের কাছে জবানবন্দি এবং আদালতে সাক্ষ্য দেন। এক বছর আগে শহর থেকে মোটরসাইকেলে বাড়ি ফেরার পথে ভাড়া করা দুষ্কৃতিকারীদের পরিকল্পিত হামলায় গুরুতর আহত হয়ে অনেকটাই পঙ্গু তিনি।
মাসুদ রানার আরও অভিযোগ, ডাক্তার আলতাফ একের পর এক মিথ্যা মামলায় পরিবারের নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের হয়রানি শুরু করেন। গ্রামের কেউ মিথ্যা মামলায় সাক্ষ্য দিতে না চাইলে তাদেরকেও সাজানো মামলায় ফাঁসানো শুরু হয়। বাপদাদার আমল থেকে ভোগদখল করা তার ৪৯ শতাংশ জমি ও পুকুর বিতর্কিত মালিকদের নিকট থেকে ওয়ারিশ সূত্রে কেনার দাবি তুলে জোরপূর্বক বেদখলের চেষ্টা চালায় আলতাফ।
আদালতে ১৪৪ ধারা জারি থাকা সত্বেও গত ডিসেম্বর থেকে মে পর্যন্ত চার দফায় তার বাড়ি, দোকানঘর, কফিশপ, গাছের বাগান এবং মিনি পার্কে হামলা ও ভাঙচুর করে। ভেকু দিয়ে মাটি ফেলে মাছ চাষ করা পুকুর ভরাটের চেষ্টা চালায়। ৯৯৯ ফোন দিয়ে তিনি দুই বার রক্ষা পান। প্রত্যেকবারই তিনি থানায় লিখিতভাবে আইনগত সহযোগিতা চান। কিন্তু টাকা আর ক্ষমতার কাছে সুবিচার হেরে যান বলে মাসুদের অভিযোগ।
এ বিষয়ে মাসুদ রানা বলেন, ‘গত এপ্রিল মাসে ছোট ছেলে ও তার সহপাঠীদের নিয়ে ধনবাড়ী নওয়াব ইনস্টিটিউট থেকে বাড়ি ফেরার পথে আলতাফ হোসেন দলবল নিয়ে আমাকে প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দেন। গত মে মাসে আমার কফিশপ, দোকান ও মিনি পার্কে হামলা করে। পরে আমার বাড়িতে এসেও আমার স্ত্রী, সন্তানসহ পরিবারের সবাইকে হত্যার হুমকি দেন। এসব ঘটনায় জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে ধনবাড়ী থানায় দুটি পৃথক জিডি করি।’
বিলাসপুর গ্রামের আবুল হোসেন বলেন, ‘আলতাফের সঙ্গে জমি নিয়ে বিরোধ ছিল একই গ্রামের নজর আলীর। সেই বিরোধকে কেন্দ্র করে প্রথমে খুন হন নজর আলীর জামাতা এখলাস। এখলাস হত্যা মামলার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী ছিলেন শ্যালক কাদের। তাই কাদেরের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন এখলাসের খুনিরা। পরে জমি দখলের ছুতায় একই খুনিরা প্রকাশ্য দিবালোকে খুন করেন কাদেরকে। আর কাদের হত্যা মামলার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী ছিলেন কাউন্সিলর মাসুদ রানা। এখন প্রকাশ্যে মাসুদ রানাকে খুন করার হুমকি দিচ্ছে চিহ্নিত ঘাতকরা। এভাবে খুনের মামলার সব সাক্ষীদের একের পর এক নিধন বা প্রাণনাশের হুমকি-ধামকি দিয়ে বেড়াচ্ছে খুনিরা। এদের হুমকির দরুন মাসুদ রানা এখন প্রাণ ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এখলাস ও কাদের হত্যার এজাহারভূক্ত আসামি ছিলেন ডাক্তার আলতাফ। কিন্তু প্রভাব খাটিয়ে সেসব মামলা থেকে অব্যাহতি পান আলতাফ।’
গ্রামের পীযুশ কান্তি বলেন, ‘আলতাফ এলাকায় ভয়ের রাজত্ব কায়েম করেছেন। তিনি কাঁচা টাকার মালিক। বেছে বেছে এলাকার গরিব ও দুর্বল মানুষকে টার্গেট করেন। তাদের জমিজমা নিয়ে হুমকি-ধামকি, মামলা-হামলা শুরু করেন। এক পর্যায়ে ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের দিয়ে জমিজমা দখল করেন।’
গ্রামের প্রবাল কুমার তালুকদার বলেন, ‘ডা. আলতাফ আমেরিকা থেকে গ্রামে এলেই মানুষের হৃদকম্পন শুরু হয়। কারণ তিনি দেশে এলেই জমিজমা নিয়ে নতুন নতুন মামলা শুরু হয়। আবার দেশ ছেড়ে আমেরিকা যাওয়ার পর পরই হয় গ্রামে খুন হয়, নয়তো কারো ওপর হামলা হয় নতুবা মামলা হয়। আর এসব করার জন্য প্রস্তুত থাকে তার ভাড়াটে রামদা পার্টি, সন্ত্রাসী বাহিনী।’
নিহত কাদের আলীর কনিষ্ঠ ভাই খলিল বলেন, ‘ডাক্তার আলতাফ বেশ কিছু জমিজমা বেদখল করেছেন। এসব বিরোধে বড় ভাই কাদের প্রকাশ্য দিবালোকে আর বোন জামাই এখলাস রহস্যজনকভাবে খুন হয়। দুই মামলারই আসামি ছিল আলতাফ। কিন্তু দু’টি মামলার চার্জশিট থেকে আলতাফ নিষ্কৃতি পান। বাবা নজর আলী ও কয়েকবার মারধরের শিকার হন। তাই মিডিয়ার কাছে মুখ খুলে জীবনের হুমকি বাড়াতে চাননা তিনি। এসব ভুলে থাকতে চান। কারণ দুনিয়ায় অনেক কিছুর বিচার হয়না।’
ধনবাড়ী পৌর শহরের ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এমবিবিএস পাশ করা একজন মেধাবী ডাক্তার যিনি আমেরিকান নাগরিক। অনেক টাকার মালিক। তিনি যখন গ্রামের বিত্তহীন, অশিক্ষিত ও অসহায় মানুষের জমিজমা না ছুতায় বেদখল করেন, হামলা বা মামলা করে ভিটেবাড়ি ছাড়ার উপক্রম করেন, তখন বিস্মিত হতে হয়।’
ধনবাড়ী পৌরসভার মেয়র মনিরুজ্জামান বকুল বলেন, ‘ডাক্তার আলতাফ খুবই মেধাবী এবং অবস্থাপন্ন মানুষ। কিন্তু খুন, দাঙ্গাহাঙ্গামা, মামলা-মোকদ্দমা পছন্দ করেন। ভাড়াটে বাহিনীর সহযোগিতায় দুর্বল ও অসহায় মানুষকে নানাভাবে হয়রানি করেন। জমিজমা, পুকুর, মসজিদ, রাস্তা নিয়ে অযাচিত বিরোধে জড়িয়ে ত্রাস সৃষ্টি করেন।’
মেয়র আরও বলেন, ‘এসব মামলা-মোকদ্দমা নিষ্পত্তি এবং এলাকায় শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য বেশ কয়েকবার পৌর অফিসে সালিশি বৈঠক ডাকা হয়। কিন্তু ডাক্তার আলতাফ সালিসে অনুপস্থিত থাকেন। ফলে এলাকায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা, জবরদখল, মামলা-হামলা বন্ধ হচ্ছে না। আমি আলতাফ হোসেনকে সাফ বলে দিয়েছি, যেন ভাড়াটে এবং বহিরাগত সন্ত্রাসীদের নিয়ে এলাকায় আর ত্রাস সৃষ্টি না করেন।’
ধনবাড়ী পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার খন্দকার খোরশেদ আলম খসরু বলেন, ‘এমবিবিএস পাশ করা একজন মেধাবী ডাক্তার দেশে ফিরলে এলাকাবাসীকে চিকিৎসা দিবেন, সেবা দিবেন এটাই প্রত্যাশা। কিন্তু তিনি গ্রামে এলে মানুষ উল্টো তটস্থ থাকেন, না জানি কখন জমিদখল, বাড়িদখল, পুকুর দখল দিয়ে মারামারি, রক্তপাত অথবা রামদা পার্টির তাণ্ডব চলে।’
বিলাসপুর গ্রামের শতবর্ষী শিক্ষক বিনয় কৃষ্ণ বলেন, ‘আমার ছাত্র আলতাফকে বহুবার বুঝিয়েছি, বাবারে তুমি একজন ডাক্তার। তোমার দিনমজুর বাবা দশজনের আর্থিক সহায়তায় তোমাকে ডাক্তারি পড়িয়েছে। আমেরিকার নাগরিকত্ব নিয়ে তুমি অনেক টাকার মালিক। মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিয়ে আশীর্বাদ অর্জন করো। খুনখারাপি, দাঙ্গাহাঙ্গামা আর মামলা-হামলা করে গ্রামবাসীর মধ্যে ক্রমাগত ভয়ভীতি সৃষ্টি করে কোন শান্তি পাবেনা। কিন্তু আলতাফ এ পরামর্শ কথা কানে তোলেনি।’
ধনবাড়ী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হারুন আর রশীদ বলেন, ‘ডাক্তার আলতাফের তো মানুষকে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার কথা। কিন্তু তিনি সেটা না করে খুন, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, মামলা-মোকদ্দমা করে এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করছেন।’
জলছত্র কুষ্ঠ হাসপাতালের সাবেক মেডিক্যাল অফিসার মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আলতাফ আমেরিকায় গিয়ে প্রচুর টাকা কামাই করেছে। ছুটিতে বাড়ি এলে অসহায় মানুষের সেবার পরিবর্তে এলাকাবাসীর সঙ্গে মারামারি, হাঙ্গামা খুনখারাপি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।’
ধনবাড়ী থানার ওসি চাঁন মিয়া বলেন, ‘ওই এলাকায় দীর্ঘ দিন ধরে খুন, মারপিট, হামলা, পাল্টা হামলার অভিযোগ রয়েছে। যাতে নতুন করে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বা শান্তি বিঘ্নিত না হয় সেজন্য থানা পুলিশ সচেষ্ট রয়েছে।’
এ ব্যাপারে ডাক্তার আলতাফ হোসেন বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ হাস্যকর ও বানোয়াট। প্রতিপক্ষরা আমাকে দু’টি খুনের মামলায় জড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পুলিশ নিরপেক্ষ তদন্ত করে সত্যটা বের করে আনে এবং চার্জশিট থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়। আমি কখনোই কোন সন্ত্রাসী বা ভাড়াটে বাহিনী পুষি না। কারও সঙ্গেই অযাচিত মামলা, হামলায় কখনোই জড়িত হয়নি। কারও জমিজমা বেদখল করিনি। বরং প্রতিপক্ষ ৪ টি মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাকে হয়রানি করছে। আমার রেকর্ডভূক্ত কিছু জমি কাউন্সিলর মাসুদ জবর-দখলের চেষ্টা করে। সেটি পুনঃদখলে নিতে কিছুটা শক্তি প্রয়োগ করতে হয়েছে। এটি কোন দোষের নয়।’
আলতাফ হোসেন আরও বলেন, ‘দেশে এলে হামলা-মামলা হয়, আর আমেরিকা চলে যাওয়ার পর গ্রামে খুন খারাপি হয়, এমন অভিযোগ মিথ্যা। পৌর মেয়র পক্ষপাতিত্ব করায় সালিশি বৈঠকে আমি যাইনি। জমি-জমা নিয়ে আদালতে মামলা চলছে। সেসব আদালতেই ফয়সালা হবে। নিউজ করে সাংবাদিকরা কাউকে জমি ফেরত নিয়ে দিতে পারবে না। সাংবাদিকরা আমাকে টার্গেট করে সবসময় ভুল খবর পরিবেশন করে। কোন নিউজে আমার বক্তব্য পুরোটা প্রকাশ করা না হলে আদালতে মামলা করব।’
Leave a Reply