মধুপুরে প্রায় কোটি টাকার মাল্টা বিক্রির স্বপ্ন দেখছেন মিজান

নিজস্ব প্রতিনিধিঃ বাতাসে টক-মিষ্টির গন্ধ। সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে উকি দিচ্ছে মাল্টা। নুয়ে পড়েছে ডালপালা। এ দৃশ্য টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার মহিষমারা গ্রামে মিজানুর রহমান মজনুর মাল্টা বাগানের। সেখানের গাছে গাছে মাল্টার ছড়াছড়ি দেখে বিমোহিত হবেন যে কেউ। কৃষি কর্মকর্তাসহ পাশের বিভিন্ন গ্রামের লোকজন প্রতিদিনই ভিড় জমাচ্ছেন সেখানে। বাগানের তিন বছর বয়সী গাছে থোকায় থোকায় মাল্টা ধরায় উপকুলীয় এ অঞ্চলে মাল্টা কিংবা কমলালেবুর মতো বিদেশি এই ফল চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখছেন বিশেষজ্ঞ ও চাষিরা। মাটির গুনাগুন বিবেচনায় বৃহত্তর সিলেট, চট্রগ্রাম, পার্বত্য চট্রগ্রাম ও পঞ্চগড় জেলায় চাষ উপযোগি হলেও মধুপুর অঞ্চলে মাল্টা ও কমলালেবুর মতো বিদেশি ফলের ভাল ফলন পাওয়া যাবে না অমুলক প্রমান হতে চলেছে এ ধারণা।

৫ সেপ্টেম্বর সোমবার মিজানের মাল্টা বাগান দেখতে মধুপুরে আসেন লেবু জাতীয় ফসলের সম্প্রসারণ,ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের পরিচালক ড.ফারুক আহমেদ। সারাদিন ঘুরে ঘুরে মাল্টা বাগান দেখেন আর ভিডিও কোরিওগ্রাফি তৈরি করেন। সাথে ছিলেন মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আল মামুন রাসেল।

জানা গেছে, প্রায় ৭ একর জমির ওপর মাল্টা বিদেশি ফলের গাছ রোপন করেন মহিষমারা এলাকার কৃষক মিজানুর রহমান মজনু। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে মাল্টা চারা নিয়ে গড়ে তোলেন বাগান। ৪-৫ জন কর্মচারি নিয়ে নিয়মিত পরিচর্যা ও দেখভাল করেন ওই ফল বাগান। কেঁচো কম্পোস্ট, ভার্মিকম্পোস্ট, খৈল, গোবর, জৈবসার আর প্রাকৃতিকভাবে পরিচর্যায় বেড়ে ওঠা বাগানের ওই সব গাছে এখন থোকায় থোকায় ঝুঁলছে বারি-১ জাতের মাল্টা । ফলের ভারে পুরো বাগানের গাছগুলো যেন নুয়ে পড়েছে।

মিজান জানান, মাটিতে গোয়ালঘরের গোবর মিশিয়ে রোপন করা হয় বারি-১ জাতের মাল্টা চারা। রাসয়নিক সার ওষুধ ছাড়াই জৈবসার আর প্রাকৃতিক উপায়ে পরিচর্যা ও নিয়মিত পানি দেওয়ায় ফল আসে গাছগুলোতে। গাছ গাছে এখন ছবির মতো ঝুঁলে আছে পাকা-আধাপাকা মাল্টা। প্রতিটি গাছে ঝুঁলে আছে অন্তত এক মন করে মাল্টা। বিক্রির সময় হলে চলতি বছর প্রায় অর্ধ কোটি টাকার মাল্টা বিক্রি করতে পারব। গাছে গাছে মাল্টা ঝুঁলে থাকার দৃশ্য দেখে স্থানীয়দের অনেকেই অভিভুত হচ্ছেন। চারা গাছ কিংবা মাল্টার কলম সংগ্রহ করতে চাচ্ছেন অনেকেই।

ফরমালিন কিংবা বিষাক্ত কার্বাইডের ভয়ে মানুষ যখন বাজারের ফলমুল কেনায় মুখফিরিয়ে নিচ্ছে তখন, আমাদের  বাগােেন উৎপন্ন সার-ওষুধ, হরমোন ও ফরমালিনমুক্ত ফল এবং বিভিন্ন গাছের চারা ও কলম বিক্রি করে ম্বাবলম্ভি হওয়া যাবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনেকে বাড়ির আঙিনায় আম, পেয়ারা, কাঠাল, কামরাঙাসহ বিভিন্ন জাতের ফল গাছ রোপণ করে শখমিটিয়ে থাকলেও ভাল ফলন পাওয়া যাবে না এই ভেবে কয়েক বছর আগেও ফল গাছের বানিজ্যিক আবাদে হাত বাড়ায়নি কেউ। কিন্তু সেই চিন্তাচেতনা এখন অমুলক প্রমান হচ্ছে। মহিষমারা গ্রামের ছানোয়ার হোসেন, জয়নাতলী গ্রামের ইদ্রিস কাজল,পাশের রসুলপুর গ্রামের শামছুল আলম মাস্টার, কদিমহাতীল গ্রামের সাংবাদিক মো.নজরুল ইসলামসহ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় মাল্টা ও কমলালেবুসহ নানা প্রজাতির দেশি-বিদেশি ফলের চাষ হচ্ছে। ক্রমাগত আবহাওয়ার পরিবর্তণ এবং রাসয়নিক সার ও বিষমুক্ত ফলের আশায় এখন অনেকেই ঘরের আঙিনায়, পরিত্যক্ত ভিটে-বাড়িসহ বানিজ্যিকভাবে বিভিন্ন ধরণের ফলদ গাছের চাষে ঝুঁকছেন। শহরের বাসাবাড়িতে কেউ কেউ আবার টবে ড্রাগন, মাল্টা, কমলাসহ বিভিন্ন ফল গাছ লাগিয়েছেন। গড়ে তুলছেন ছাদ বাগান।

উপজেলা সহকারি কৃষি কর্মকর্তা সুব্রত দেবনাথ বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তণ আর গাছপালা-বনজঙ্গল কেটে বিনস্ট করায় দেশি প্রজাতির বিভিন্ন ফল গাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। পড়ছে বিরুপ প্রভাব। ভুটান, ব্রাজিল, ভারত, পাকিস্তান, আমেরিকা, চীন, অস্টেলিয়ায় অধিক পরিমানে মাল্টা ও কমলা উৎপাদন হয়। সমতলে ৬০ সেন্টিমিটার বর্গাকার বা আয়তাকার গর্ত করে ৪-৫ মিটার দূরত্বে বৈশাখ মাসে চারা বা কলম লাগাতে হয়। মাদা তৈরীর করে প্রতি গর্তের মাটির সঙ্গে ১৫ কেজি পচা গোবর, ২৫০ গ্রাম টিএসপি, সমপরিমান এমওপি ও চুন, ৩-৫ কেজি ছাই মিশিয়ে ভরাট করে ১০-১৫ দিন পরে চারা বা কলম লাগাতে হয়। এরপর হালাকা সেচ দিতে হয়। আগাছা দমনসহ বর্ষকালে গাছের গোড়ায় যাতে পানি না জমে সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। চারা অবস্থায় মাল্টা ও কমলালেবু গাছের গোড়া থেকে গজানো অতিরিক্ত কুশি বা মাথা এবং মরা ও রোগাক্রান্ত ডাল মাঝে মাঝে ছেটে রাখতে হয়। তিনি আরো জানান, মাল্টা সর্দিজ্বর ও বমি নিবারক হিসেবে ভাল কাজ করে। মাল্টা কিংবা কমলার শুকনো ছাল অম্ল ও শারিরীক দূর্বলতা নিরসনে কাজ করে। মাল্টা ও কমলার জ্যাম, জেলি ও জুসের চাহিদা আছে।’

চাপড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো.শফিকুল ইসলাম সবুজ বলেন, ‘সিলেট, চট্রগ্রাম, পার্বত্য চট্রগ্রাম ও পঞ্চগড় জেলাসহ বিদেশের মাটিতেই কেবল ভাল কমলা কিংবা মাল্টা ফলে এমন ধারণা পাল্টে যাচ্ছে। বীজ থেকে সরাসরি চারা তৈরী করা যায়। ভাল জাতের মাল্টা বা কমলালেবুর চোখ কলম, পার্শ্বকলম ও ১০-১২ মাস বয়সের চারা বাডিং ও গ্রাফটিংয়ের জন্য আদিজোড় হিসেবে ব্যাবহার করা ভালো। সোজা ও ভাল বৃদ্ধি সম্পন্ন তরতাজা চারা অথবা কলম বেছে নিয়ে রোপন করা উচিত। দেশি প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় ফল গাছের পাশাপাশি মিজান গার্ডেনে মাল্টার মতো পুষ্টিমান সম্পন্ন পরিবেশ বান্ধব ফল গাছের পরিকল্পিত বনায়ন করা জরুরি।’

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আল মামুন রাসেল বলেন, ‘মাল্টা ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ও জনপ্রিয় ফল। উপকুলীর বাউফলের বিভিন্ন এলাকায়ও এখন কমবেশি মাল্টা ও কমলার চাষ হচ্ছে। মিজান গার্ডেনে মাল্টার নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে অভিভূত হবেন যে কেউ। পুষ্টির চাহিদা পূরণে অন্য পেশার পাশাপাশি শিক্ষিত লোকজনের এ ধরণের ফল চাষে এগিয়ে আসা উচিত।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এ বিভাগের আরো সংবাদ
Share via
Copy link
Powered by Social Snap