মধুপুরের প্রথম অনলাইন সংবাদপত্র

শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০৮:০৪ পূর্বাহ্ন

First Online Newspaper in Madhupur

শিরোনাম :
ভুঞাপুরে হিট‌স্ট্রো‌কে আক্রান্ত হ‌য়ে অসুস্থ্য শিক্ষার্থী সখীপুরে শাল-গজারি বনে এক মাসে ২৫ স্থানে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা নাগরপুরে তিনদিন ব্যাপী খাদ্যভিত্তিক পুষ্টি বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত ঘাটাইলে সংরক্ষিত বনাঞ্চল আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করছে দুর্বৃত্তরা টাংগাইলে নায়ক মান্নার বাসা থেকে ৬ শত ২০ মিটার রাস্তার উন্নয়ন কাজের উদ্বোধন নাগরপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমানের ইন্তেকাল ঘাটাইলে সড়ক দুর্ঘটনায় এক ব্যক্তি নিহত টাংগাইলে কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন বিতরন নাগরপুরে প্রবাসীকে হত্যার অভিযোগে দুইজন গ্রেফতার মাভিপ্রবিতে বিতর্কে জয়ী বিরোধী দল ‘ভগ্নমনস্কতা’

এখনো গারো সমাজে চু-এর মর্যাদা কমেনি

সংবাদ দাতার নাম
  • প্রকাশের সময় : সোমবার, ১ এপ্রিল, ২০২৪
  • ১১১ বার পড়া হয়েছে

টাঙ্গাইলের মধুপুর বনাঞ্চলের ধরাটি গ্রামের গারো তরুণী আশা দালবতের বিয়ের দিনটি ছিল উত্সবমুখর। গারো রীতি অনুযায়ী পার্শ্ববর্তী জয়নাগাছা গ্রামের সুদর্শন যুবক লিন্টুলিয়ো নকরেক ঘরজামাই হয়ে আসায় কনে আশা দালবতের বাড়িতে ছিল বাড়তি উচ্ছ্বাস।

মাহারীর (আত্মীয়পরিজন) লোকজন নিমন্ত্রণে আসছেন আর রিকশাভ্যান থেকে বড় রাং (মাটির বড় পাতিল) নামিয়ে সারিবদ্ধভাবে উঠানে রাখছেন। অতিথিদের কেউ কেউ সেই রাংয়ের ঢাকনা খুলে নাক চুবিয়ে ঘ্রাণ নিচ্ছেন।

আর কোনো কোনো রাংয়ে রাখা হলদে পানীয়ের উচ্ছসিত প্রশংসা করছেন।

কেউ কেউ অনুষ্ঠানে আসা অতিথিদের উদ্দেশ্যে উঁচু গলায় বলছেন, ‘ভাইরে, ভেদুরিয়া গ্রাম থেকে আসা ১০ নম্বর রাংয়ের মাল একবারে খাসা।

রাংয়ের ভেতরের ঐ যে খাসা মাল, সেটি হচ্ছে গারোদের ঐতিহ্যবাহী পানীয় বা মদ। স্থানীয়ভাবে যাকে বলা হয় চু-বিচ্ছি।

চু-বিচ্ছি বা গারো মদ আদিবাসী গারো সম্প্রদায়ের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং আবহমান সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আদিতে গারো মদ বা পানীয় ছিল মান্দি ধর্ম বা সাংসারেক ধর্মের উপকরন। শুধু বিয়ে-সাদি নয়, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের পরতে পরতে গারো চু-বিচ্ছি অপরিহার্য।

এখনো গারো সমাজে চু-এর মর্যাদা কমেনি। ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং যে কোনো পালাপার্বন বা জমায়েতে জাঁকজমক চু পার্টির আয়োজন হয়। সেই পার্টিতে কলার পাতা ও কলার খোল ভরে বড় খানার ব্যবস্থা থাকে।

বড় খানার পর জাঁকজমকপূর্ণ চু পার্টিতে অংশ নেয় অশীতিপর বৃদ্ধ, কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতিরা।

বাংলাদেশে ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে একমাত্র মাতৃতান্ত্রিক সমাজের অধিকারী হলো গারোরা। দেশে গারো জনসংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ।

বৃহত্তর ময়মনসিংহের গারো পাহাড়ের পাদদেশ এবং টাঙ্গাইলের মধুপুর বনাঞ্চল জুড়ে গারোদের বসবাস। গারোদের শিক্ষার হার প্রায় ৯৫ শতাংশ। পরিবারে মায়েরাই শেষ কথা। তাই পরিবারে সন্তানের পরিচয় হয় মায়ের নামে।

সময়ের পরিক্রমায় গারোরা প্রায় সবাই খ্রিষ্টান হলেও আদি ধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ে অনেক সাংসারেক গারোর দেখা মেলে। খ্রিষ্টান অথবা সাংসারেক যাই হোক না কেন, নবান্ন উত্সবে গারো পল্লি খুশিতে মেতে ওঠে। তখন চু বা মদের চাহিদা বেড়ে যায়। তখন প্রতিটি বাড়িতে চু-বিচ্ছি তৈরির প্রতিযোগিতায় চলে।

কোনো বাড়ির চু বেশি স্বাদের বা বেশি নেশার উদ্রেক করে সেটি নিয়ে সামাজিকভাবে মূল্যায়ন শুরু হয়। যে বাড়ির চু সর্বোচ্চ স্বাদের হয়, তাদের সামাজিক খ্যাতি অনেকখানি বেড়ে যায়।

চু নিয়ে গারোদের বেশ কিছু মজার গানও রয়েছে। কোনো পরিবারে নতুন জামাই এলে চু দিয়ে আপ্যায়নের সময় গানের কিছু মজার লিরিক গাওয়া হয়।

গারো তরুণী চিম্বুক ফেলিস্তা জানান, গারো বিয়েতে প্রচুর খরচ হয়। কনের পরিবার দরিদ্র হলেও খরচে ছাড় নেই। আত্মীয়স্বজন বা মাহারীর লোকজন সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসে। বিয়ের খরচের বড় একটি অংশ থাকে চু পার্টির আয়োজনে। বিয়ের আগে ও পরে টানা চার-পাঁচ দিন ধরে চলে চু পানের আসর।

যাই হোক, গারোদের জীবনাচরণ, সামাজিকতা ও সংস্কৃতির প্রতিটি পরতে যে পানাহার অতীব জরুরি, তা হলো চু। গারো সমাজ ও সংস্কৃতি গ্রন্থে বলা হয়েছে, সুপ্রাচীনকাল থেকেই গারোরা চু’র ভক্ত। চু হচ্ছে স্বর্গীয় সুধা। তাই সব পূজা-পার্বণে দেবতার উদ্দেশে গারোরা চু উত্সর্গ করত। তারপর সেই চু সুধামৃত জ্ঞানে পান করত।

গারো জীবনে চাহিদা এখনো কম। স্বল্প কামনা-বাসনায় তারা নিজেদের সুখী ভাবে। এ জন্য গারোদের সুখবাদী দর্শনের অনুগামী বলা হয়।

মধুপুর বনাঞ্চলের কোনো কোনো গ্রামের গারোরা এখনো আদি গারো ধর্ম পালন করে থাকে। তারা নানা দেবদেবতায় বিশ্বাসী। এদের সংখ্যা বড়জোর হাজারখানেক।

তারা গারোদের প্রাচীন ধর্ম, যাকে সাংসারেক বা মান্দি ধর্ম বলা হয়, সেটির অনুশীলন করে।

মধুপুর বনাঞ্চলের ভেদুরিয়া গ্রামের সাংসারেক গারো শীতল স্নাল পেশায় একজন গীতিকার ও সংগীতশিল্পী। গারো রীতিতে তিনি ওয়ানগালা, পূজা-পার্বন এবং ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করেন। স্নাল জানান, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত গারো জীবনের প্রতিটি স্তরে চু-বিচ্ছি অপরিহার্য। শিশুর জন্মের আগেই ঘরে তৈরি হয় চু। আতপ চালের খামি গুঁড়া, পাহাড়ি লতাগুল্ম, শুকনো মরিচসহ কিছু ভেষজ পণ্যে তৈরি হয় নির্ভেজাল চু।

নবজাতকের আগমনের পর বাড়িতে উত্সবের আমেজ তৈরি হয়। আয়োজন হয় চু পার্টির, যাকে বলা হয় চু-জাঙ্গী। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নবজাতকের দীর্ঘায়ু ও সমৃদ্ধি কামনা করা হয়। যেন নবজাতক প্রকৃতিবাদী হয়ে ওঠে।

গারো স্কুলশিক্ষক সীমন নকরেক কথা প্রসঙ্গে জানান, গারোদের বিয়ে, নবান্ন উত্সব, আমুয়া (পূজা) এবং শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে চু অপরিহার্য।

পরিবারের কেউ মারা গেলে আত্মীয়স্বজন শূকর, ছাগল, গরু, হাঁস-মুরগি, চাল-ডালের পাশাপাশি রাং ভর্তি চু নিয়ে আসেন।

মৃত ব্যক্তির সত্কারের পর শোকের বাড়িতে হয় চু-পার্টি। সাংসারেক গারোরা জীবনকে প্রকৃতির মতোই উদার ও সহজভাবে দেখে থাকে।

এনজিও কর্মী শায়ন্ত মারাক জানান, চু ছাড়া গারোজীবন অচল। হোক সে খ্রিষ্টান বা সাংসারেক। তবে যারা প্রটেস্ট্যান্ট খিষ্টান, তারা চু কম সেবন করেন। কোনো কোনো গারো গ্রামে আদি চু-বিচ্ছির পরিবর্তে চোলাই মদ তৈরি হয়। চোলাই হলো ভর মাদক। কিন্তু চু-বিচ্ছি মাদক নয়। এটি স্বর্গীয় সুধা এবং গারো সংস্কৃতির আদি অনুষঙ্গ।

মধুপুর উপজেলার জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি গারো নেতা ইউজিন নকরেক জানান, পরিমাণ মতো চু পান স্বাস্থ্যসম্মত। এতে অ্যালকোহল কম। কিন্তু চোলাই মদে প্রচুর অ্যালকোহল থাকায় স্বাস্থ্যের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর। গারো সমাজে চোলাই পান বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যাওয়ায় সামাজিক অস্থিরতা ও অশান্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।

গারো সংস্কৃতির এক গবেষণাপত্রে বলা হয়, জন্ম, মৃত্যু, বিয়েসাদি, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়াও ৪৩টি কারণে চু বা চোলাই পার্টি হয়।

কোনো কোনো পরিবার চু বা চোলাই পার্টির নামে গোলার ধান পুরোটাই নিঃশেষ করায় পরে অনাহারে থাকে। নতুন ঘর নির্মাণ, গবাদি পশু বা যানবাহন ক্রয়, নতুন চাকরি বা প্রমোশন অথবা জমিজমা কেনাবেচা এমনকি ব্যাংক ঋণ পেলে চু বা চোলাই পার্টির আয়োজন হয়।

এসব পার্টির দরুন সমাজে নানা অনাচার দেখা দেয়। নারী নির্যাতন, পারিবারিক কলহ এবং গোষ্ঠীগত চিরায়ত মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটে।

গারো চারু, কারু, বস্ত্র ও ফ্যাশন শিল্পের সমঝদার ও অনলাইন উদ্যোক্তা মুনমুন নকরেক জানান, চু আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী পানীয়। কিন্তু ঐত্যিহের নামে এটার অপব্যবহার হচ্ছে। নেশা হিসেবে অবলম্বন করায় সমাজে নারীরা নিগৃহীত হচ্ছে। পারিবারিক অশান্তি দেখা দিয়েছে।

মধুপুর বনাঞ্চলের পীরগাছা সেন্টপৌলস গির্জার ফাদার লরেন্স রিভোরি বলেন, গারো চু বা চোলাই মদ যেন সবাই উপেক্ষা করেন, সেজন্য সচেতন করা হচ্ছে।

যাই হোক, গারো তরুণী আশা দালবদের বিয়ের অনুষ্ঠানে মধ্যাহ্নভোজ শেষে শুরু হয় চু পার্টি। রাং থেকে ফাং দিয়ে চু উঠিয়ে পান করছে সবাই। গারো গান আর নাচ তো ছিলই।

এরই মধ্যে নেশায় বুঁদ হয়ে গ্রামের গারো নেতা সুশাং নকরেক মাইকে ঘোষণা দিতে থাকেন, ‘ভাইছব, গারোরা চু খায় চু। গারোরা মদ খায় না। কারণ মদ খাওয়া ভালো না।’

লেখক : জয়নাল আবেদীন, সাংবাদিক ও অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক

সংবাদ টি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ
©2024 All rights reserved
Design by: POPULAR HOST BD
themesba-lates1749691102
Verified by MonsterInsights