নিজস্ব প্রতিনিধিঃ টাঙ্গাইলে ঘাটাইল উপজেলার সাগরদীঘি এলাকায় ভূঁইয়াদের আধিপত্য অনেক আগে থেকেই। বলা যায়, বংশ পরম্পরায় এটি চলে আসছে। এই ভূঁইয়াদের দখলে আছে বনের প্রায় ১৫ একর জমি।
এসব জমি দেখভালের দায়িত্বে আছেন ভূঁইয়া বংশের সবচেয়ে বয়জ্যেষ্ঠ ব্যক্তি খসরু ভূঁইয়া। বয়স ৮০ ছুঁইছুঁই। বাড়ি সাগরদীঘি ইউনিয়নের মালিরচালা গ্রামে।
গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ভূঁইয়াদের বন দখলের চিত্র।
দখল করা ৩০৮ দাগের জমির অবস্থান মালিরচালা ও পাগারিয়া মৌজায়। এই দুই মৌজা ভেদ করে চলে গেছে ঘাটাইল-সাগরদীঘি সড়ক। ওই এলাকায় সড়কের দুই পাশেই তাদের ‘রাজত্ব’।
সরেজমিন গিয়ে ভূঁইয়াদের বন দখলের বিষয়ে জানতে চাইলে মালিরচালা গ্রামের ছোট-বড় সবাই মুখে কুলুপ আঁটেন। তাদের বিরুদ্ধে কথা বলা মানে ‘জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করা।’
দখল করা জমিসংলগ্ন স্থানের নামকরণ করেছেন আমতলা। সেখানে কলাচাষি সেজে চা পানের ছলে কথা হয় দোকানদারসহ অন্যদের সঙ্গে।
তারা জানান, মালিরচালা মৌজায় ভূঁইয়াদের দখল করা জমি বছরে বিঘা প্রতি (৫০ শতাংশে এক বিঘা) ৩৮ হাজার টাকায় ইজারা নিয়ে কলা ও পেঁপে চাষ করেছেন খসরু ভূঁইয়ার ভাতিজা সজিব ভূঁইয়া।
পাগারিয়া মৌজায় বিভিন্ন জাতের কলা চাষ করেছেন পাশের উপজেলা সখীপুরের আরিফ হোসেন নামে এক ব্যক্তি।
জমিগুলো রেকর্ডভুক্ত না বন বিভাগের– এমন প্রশ্নে স্থানীয়রা বলেন, কিছু রেকর্ড আর বাকিটা বন বিভাগের।
বনের জমি কীভাবে খসরু ভূঁইয়া দখল করে ভোগ করছেন? বন বিভাগ কিছু বলছে না–এমন প্রশ্ন শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন অনেকে।
তাদের ভাষ্য, দখল হওয়া জমির অবস্থান ঘাটাইল-সাগরদীঘি সড়ক ঘেঁষে। এই সড়ক দিয়েই বন কর্মকর্তাদের চলাচল। তারা দিনেও চলেন ‘চোখ বন্ধ’ করে। তাহলে বন দখল দেখবেন কী করে।
ঘটনাস্থল থেকে বন বিভাগের সাগরদীঘি বিট অফিসের দূরত্ব তিন কিলোমিটারের বেশি নয়।
চায়ের দোকানে উপস্থিত অনেকেই জানান, খসরু ভূঁইয়ার ছোট ভাই নিজাম ভূঁইয়ার এক আত্মীয় বন বিভাগে চাকরি করেন। তাঁর মাধ্যমেই নাকি সব সমাধান হয়।
মধ্যবয়সী একজন বলে উঠলেন, সিনেমার ভিলেন মিজু আহমেদ কোনো এক ছবিতে ডায়ালগ দিয়েছেন– ‘আমার হাত ডুবাই (দুবাই) পর্যন্ত লম্বা।’ তেমনি ভূঁইয়াদের হাত অনেক লম্বা।
ঘাটাইল উপজেলার এক-তৃতীয়াংশ হচ্ছে পাহাড়ি অঞ্চল। এখানে মোট বনভূমি ২৫ হাজার ৭১১ একর।
বন বিভাগের তথ্যমতে, ২ হাজার ৫৩ একর বনের জমি দখলে রয়েছে। এসব জমিতে বড় বড় দালান, লেবু, মালটা, কলা পেঁপে ও ড্রাগনের বাগান করেছেন দখলদাররা। অনেকে বনের জমি দখল নিয়ে ইজারা দিয়ে লাভবান হচ্ছেন।
ভূঁইয়াদের দখলে থাকা মালিরচালা মৌজায় পেঁপে ও কলা বাগান করেছেন সজিব ভূঁইয়া।
তাঁর ভাষ্য, বছরে বিঘাপ্রতি ৩৮ হাজার টাকায় খসরু ভূঁইয়ার কাছে থেকে ১০ বিঘা জমি ইজারা নিয়েছেন তিনি। প্রায় ২০ বছর ওই জমিতে কলাচাষ করেছেন সখীপুরের ময়না মেম্বার।
তিনি বলেন, ‘ভূঁইয়াদের কাছে থেকে আমি ১৪ একর ৫৫ শতাংশ জমি ইজারা নিয়েছিলাম।’ তাঁর জানা মতে কিছু জমি রেকর্ড আর বাকিটা বন বিভাগের।
পাগারিয়া মৌজায় কলা বাগান করেছেন আরিফ হোসেন নামে এক ব্যক্তি। মোবাইল ফোনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।
তবে স্থানীয়রা জানান, বিঘাপ্রতি একই দামে ইজারা নিয়েছেন আরিফ।
বনের জমি দখল করার কথা স্বীকার করে খসরু ভূঁইয়া বলেন, ‘মালিরচালা ও পাগারিয়া মৌজায় আমাদের রেকর্ডভুক্ত জমি আছে। আবার আমাদের দখলে বন বিভাগেরও কিছু জমি আছে।’
বনের জমি দখলের পরিমাণ কত–এমন প্রশ্নে পরিপূর্ণ তথ্য না দিতে পারলেও অনুমান করে বলেন, মালিরচালা মৌজায় চার একর এবং পাগারিয়া মৌজায় চার একর বনের জমি তাদের দখলে আছে। বন বিভাগ এই জমি উদ্ধার করতে আসে না।
সাগরদীঘি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. হাবিবুল্লাহ্ জানান, বহু বছর ধরে বসবাসরত লোকজন ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণের সময় বন বিভাগের হয়রানির শিকার হয়। মোটা অঙ্কের উৎকোচ না দিলে বন বিভাগ বাড়ি সংস্কার করতে দেয় না– এমন অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু প্রভাবশালীরা একরের পর একর জমি দখল করলেও বন কর্মকর্তাদের চোখে পড়ে না। তারা প্রভাবশালীদের সঙ্গে সন্ধি করেই চলেন।
বন বিভাগের সাগরদীঘি বিট কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘ওই জমিগুলো আমি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় দখল হয়নি। আমি যোগদানের পর দখল হওয়া ৫ হেক্টর জমি উদ্ধার করেছি। সামাজিক বনায়ন শুরু হলে ভূঁইয়াদের দখলে থাকা ওই জমিও উদ্ধার করা হবে।’
ঘাটাইলের ধলাপাড়া রেঞ্জ কর্মকর্তা ওয়াদুদুর রহমানের ভাষ্য, বনের জমি যারাই দখল করে, তালিকা করে তাদের নামে মামলা দেওয়া হয় এবং উচ্ছেদ করে বাগান করা হয়।
সাগরদীঘির ভূঁইয়াদের বিরুদ্ধে জমি দখলের কোনো মামলা হয়েছে কিনা–জবাবে তিনি বলেন, বিষয়টি তাঁর জানা নেই। তবে দখলে থাকা জমি উদ্ধার করে অচিরেই বাগান করা হবে।