ফলে নদী ও খালের পানি ব্যবহারকারীরা পড়েছেন বিপাকে। স্থানীয়দের অভিযোগ, তারা নদী ও খাল থেকে মাছ ধরলেও সেই মাছ রান্নার পর দুর্গন্ধে খাওয়া যাচ্ছে না।
কারখানার বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ চর্মরোগ, পানিবাহিত রোগ এবং উল্লেখযোগ্য পরিবেশগত ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া মানবজীবন এবং জলজ জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পাকুল্যা খালের পাশে চাপ্তাই বাঁশের চাটাই তৈরির কাজে নিয়েজিত পাকুল্যা গ্রামের বাসিন্দা রফিক মিয়া বলেন, ‘এখানে ১৫ বছর ধরে কাজ করছি। আমাদের চাটাই তৈরির কাজের জন্য আনা বাঁশ পাকুল্যা খালে ভিজিয়ে রেখে কাজ করি। গত দুই বছর ধরে সাদিয়া কারখানার দূষিত পানি খালে ফেলায় পানি দুর্গন্ধ ও কালো কুচকুচে হয়ে পড়েছে। পানিতে নামলে শরীর চুলকায় এবং ঘা হয়।’
শ্রমিক আরশাদ মিয়া বলেন, ‘পানি কালো হয়ে গেছে। নদীর বড় বড় মাছ মাঝে মধ্যে মরে ভেসে ওঠে। দুর্গন্ধে বেশি সময় থাকা যায় না। এই খালের পানি লৌহজং নদীতে পড়ছে। লৌহজং নদীর মাছও মরে ভেসে ওঠে। বিষাক্ত পানি নদীতে আসায় এখন গোসল করতে পারি না, জমিতে সেচ দিতে পারি না।’
পাকুল্যা গ্রামের বাসিন্দা রমজান আলী বলেন, ‘আমাদেরকে দেখার মতো কেউ নাই। কারখানার দূষিত পানিতে খালের পানির রং এমন হয়েছে। নদীর পানি আমরা পান করতাম, মাছ ধরতাম। এখন পান করা মাছ ধরা তো দূরে থাক, দুর্গন্ধে বাড়িতেও বসবাস করা দায় হয়ে উঠেছে। ভোর থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত দুর্গন্ধজনিত পানি বেশি ছাড়া হয়।’
কলেজছাত্র কহিনুল ইসলাম, শাকিল ইসলাম, ইমরান খান রাজা বলেন, সাদিয়া টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের রাসায়নিক বর্জ্য খালের পানিতে ফেলায় জনজীবন, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে। তারা খালের দুর্গন্ধযুক্ত কালো পানি সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠিয়েছেন। বর্তমান সরকারের পরিবেশ উপদেষ্টার কাছে কারখানার দূষিত বর্জ্য খালে ফেলার বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জোর দাবি জানান তারা।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন ফাউন্ডেশনের (বিএমবিএফ) পর্যবেক্ষণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আকিব আকবর খান চৌধুরী বলেন, ‘সাদিয়া টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের শিল্পবর্জ্রের দূষণ চরম আকার ধারণ করেছে। যা ফসলের ক্ষতি, নিরাপদ পানির অভাবসহ চরম পরিবেশ ও মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো চলমান বেপরোয়া ও অপরিকল্পিত শিল্পায়ন এবং পরিবেশ ও মানবিক বিপর্যয়ের কথা অনেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরে পরিকল্পিত ও উৎসে বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু কেউই এ বিষয়ে কর্ণপাত করছেন না।’ তিনি সাদিয়া টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের বর্জ্য ফেলা বন্ধে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন বলে জানান।
জামুর্কী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ডি এ মতিনের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, এলাকাবাসীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পাকুল্যা খালের সাটিয়াচড়া এলাকায় সরেজমিনে দুর্গন্ধযুক্ত কালো পানি দেখতে পান। পরে কয়েকটি গ্রামের ২০-২৫ জন গণ্যমান্য ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে সাদিয়া কারখানায় গিয়ে মালিকের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলি। তিনি তার কারখানার ইটিপিতে সমস্যা হচ্ছে জানিয়ে বলেছিলেন দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রকৌশলী এনে সমাধান করা হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সমাধান করা হয়নি। খাল ও নদীতে বড় বড় বোয়াল মাছ মরে ভেসে উঠছে বলে এলাকার লোকজন জানিয়েছেন। দুর্গন্ধযুক্ত কালো পানিতে এলাকার পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে বলে তিনি জানান।
সাদিয়া টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের প্রকল্প পরিচালক আব্দুর রহমানের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি বলেন, ‘কারখানার পানি ইটিপি করে রেঞ্জের মধ্যে রেখে পাইপের ড্রেনের মাধ্যমে খালে ফেলা হচ্ছে। এই পানিতে দুর্গন্ধ ও পোকার উৎপত্তি হবে না।’
পরিবেশ অধিদপ্তর টাঙ্গাইল অফিসের পরিচালক মিয়া মাহমুদুল হকের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি।
পানি উন্নয়ন টাঙ্গাইলের নির্বাহী প্রকৌশলী মতিউর রহমানের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আগে জানা ছিল না। খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তবে এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাজ করার সুযোগ রয়েছে।’ নির্বাহী কর্মকর্তাকে এ বিষয়ে অবগত করার পরামর্শ দেন তিনি।
মির্জাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ বি এম আরিফুল ইসলাম অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘পরিবেশ ও কল-কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে কপি পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’