আপনি ইতিহাস গুলে কাঁচা মরিচ ডলছেন
২০০৬ সালের অক্টোবর মাস। মানুষকে সাপের মতো পিটিয়ে মেরে তার উপর নাচলো দুর্বৃত্তরা। আপনি এর নাম দিলেন বিপ্লব। হলো ওয়ান-ইলেভেন। আর তার ফল হলো বিগত ১৬ বছরের ফ্যাসিস্ট শাসন। তথাকথিত চেতনার সেই শাসনে দেশ হয়ে গেল লুট। আর আপনি এখন হিসাব মেলাতে এসেছেন- আগের চেয়ে আলুর কেজি কতো বেশি।
গত ১৬ বছরে আপনি দেখলেন ভয়ঙ্কর সব যাদু। দেখলেন সৎ সাংবাদিক সাগর-রুনির লাশ ও একটি এতীম শিশু। নিঠুর গলায় বলতে শুনলেন- ‘কারও বেডরুমের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব সরকারের না।’ আপনি চুপ থাকলেন।
প্রথম সারির রাজনীতিবিদ ইলিয়াস আলীর গুম হওয়াটা ছিল আপনার কাছে চেতনার প্রতীক। বাবা একরামকে গুলি করে হত্যার শব্দ মোবাইলে শুনে স্ত্রী কন্যা যখন কেঁদেছিল, সেই চোখের পানিতে আপনি পেয়েছিলেন চেতনার ঝর্ণাধারা। আর এখন এসেছেন হিসাব মেলাতে- আগের চেয়ে লাউয়ের দাম কয় টাকা বেশি।
২০১৩ সালের দিকে সিলেটে রাজন নামের এক গরিব শিশুকে এক ফ্যাসিস্ট দোসর দিনের আলোয় পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল। আপনি আর খোঁজ নেননি। কারণ সেই হন্তারক ছিল আপনার চেতনার সৈনিক।
বেশ কয়েক বছর আগে। ঢাকার বাড্ডার এক স্কুলে বোরকা পরা এক নারী অভিভাবককে চোর সন্দেহে মানুষ দিনে দুপুরে পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল। আপনি সেই বর্বরতার প্রতিবাদ করেননি। কারণ, তা চলে যেতো আপনার চেতনার শাসকের বিপক্ষে। আর এখন আপনি কথা বলছেন ডিমের হালি নিয়ে।
২০০৯ সালে এক নৃশংস হত্যাকাণ্ডে দেশ হারায় ৫৭ জন দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তাকে। আপনি রা করেননি। রা করলেই তো আপনার চেতনার বেলুন চুপসে যাবে। এখন আপনি এসেছেন পেঁপে- চালকুমড়ার বাজার দর নিয়ে।
বেশ কয়েক বছর আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এক প্রতাপশালী বিশেষ সহকারী ছিল। গুলশানের এক জাপানি রেস্তরাঁয় নিয়মিত রঙিন আসর জমাতো। এটা ছিল ওপেন সিক্রেট। শোনা গিয়েছিল, জাপানি মহিলার মালিকানাধীন সেই রেস্তরাঁই সে দখল করে ফেলেছিল শেষমেশ। আপনি টুঁ শব্দটি করেননি।
বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদের দোষ ছিল সে ভারত বিরোধী আর নামাজ পড়তো। তাকে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা রুমে ডেকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করলেও আপনি মুখে টেপ মেরে ছিলেন।
ছোট্ট মেয়ে ফেলানীর লাশ সীমান্তের কাঁটাতারে যখন ঝুলছিল, আপনার নারীবাদী চেতনা টুপ করে লুকিয়ে গেল। কিন্তু সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন এক নারী ভাট্টি’কে কিছু বলায় আপনার চেতনা মানববন্ধন থেকে লাফিয়ে মামলায় চলে গেল। কোর্টে এই সিনিয়র আইনজীবীকে ফ্যাসিস্ট দোসররা রক্তাক্ত করলো। কোর্টে আক্রমণে রক্তাক্ত হয়েছিলেন আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। অন্যায়ভাবে জেলে নির্যাতন করে দেশছাড়া করা হয়েছিল বয়োজ্যেষ্ঠ সাংবাদিক শফিক রেহমানকে। আপনি এসবে খুঁজে পেলেন চেতনার বিজয়। আর এখন দেশপ্রেমিক বিপ্লবী ছাত্রছাত্রীদের বলছেন ‘এগুলা বেয়াদপ।’ অথচ এই বিপ্লবের সময় যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের সরকারি গুণ্ডারা লাঠি দিয়ে মারছিল, আপনি চেতনার চোটে সেখানে নারী দেখেননি।
তনু হত্যায় আপনি নারীকে পাননি, পেয়েছিলেন হিজাবি। অথচ রাজধানীর ক্লাব-হোটেলে লুটেরা এলিটদের রাতভর বেলেল্লাপনায় আপনি শুনেছেন প্রগতিশীলতার ডামাডোল।
সেক্যুলার মুখোশে মুসলিম বিদ্বেষী ফ্যাসিজমকে সমর্থন করেছেন আপনি এই ৯২ শতাংশ মুসলিমের দেশে। কেউ নামাজ পড়লেই তাকে আড়চোখে মেপেছেন। দাড়ি টুপি পরা সম্মানিত মানুষকে অপমান করেছেন। স্যুট টাই পরা চোর-লুটেরাদের দাঁড়িয়ে সম্মান দেখিয়েছেন। আর এখন এসেছেন আপনি পিয়াজের বাটখারা মাপতে।
২০১৮ সালে ছোট্ট স্কুল শিশুদের ‘নিরাপদ সড়ক’ আন্দোলনে পুলিশ আর হেলমেট বাহিনী যখন শিশুদের ওপর হাতুড়ির আক্রমণ চালায়, বাচ্চাদের অ্যরেস্ট করে, আপনি সেটাকে দেখেছেন চেতনার বিজয় হিসেবে। বিগত ১৬ বছরে দেশ দেখেছে কীভাবে প্রতিপক্ষকে গুম করে খুন করে বস্তায় ভরে পাথরে বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেয়া হয়। আপনি দেখেননি। আপনি কানাগলির অন্ধ।
মিডিয়াগুলোর নির্লজ্জ চাটুকারিতা আর দলবাজি আপনার চেতনার বিবেককে আনন্দ দিয়েছে। দেশের উঁচু চেয়ার থেকে মানুষকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে কাঁঠালের বার্গার, পিয়াজ ছাড়া রান্না, রোজদারকে মিষ্টিকুমড়া দিয়ে বেগুনী আর কাঁচামরিচ শুকিয়ে পরে ভিজিয়ে রান্না করতে বলে আপনি মজা পেয়েছিলেন। আর এখন এসেছেন ৩০০ টাকা কেজির কাঁচামরিচে ডলা দিতে।
জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে ৪ বছরের শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত হাজার হাজার ছাত্র-জনতা নির্মমভাবে নিহত হয়েছে, ছাত্রের লাশ রিকশার পা-দানীতে উঠিয়ে দেয়া হয়েছে, ভ্যানে শহীদদের মৃতদেহ জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে, পাওয়া গেছে গণকবর। দেশের মানুষের পকেট কেটে ১৬ লাখ কোটি টাকা চুরি করে ভেগেছে চোরের রাজা-রানী-উজির-নাজির। এরপরও আপনার চেতনা পরাজিত ফ্যাসিস্টের জয়গান গায়।
বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আব্দুল আউয়াল মিন্টুর সেন্স অফ হিউমার ভালো। অভিজাত নোয়াখালী, শুদ্ধ বাংলা আর ইংরেজির মিশ্রণে উনার কথা শুনতে মজা লাগে। আগস্ট বিপ্লবের আগে একটা টিভি সাক্ষাতকারে তিনি চীনাদের লেনদেন নিয়ে বলছিলেন- ‘তারা এমনে বালো (ভালো), কিন্তু যদি আমনে (আপনি) তেড়িবেড়ি করেন, দরি (ধরে) এক্কেরে শুইচের (সুঁচ) লাহান সোজা করি হালাইবো।’ দেশে ছাত্র-জনতার জাগরণ হয়েছে। আপনি যদি এখনো রক্তস্নাত বিপ্লবকে বুড়ো আঙ্গুুল দেখিয়ে কাঁচামরিচ ডলতে থাকেন, তবে মিন্টু সাহেবের মতো কেউ বলতে পারে- ‘হোলাহাইন আর পাবলিকে মিলি যহন জুইত মতোন দইরবো, এক্কেরে কাঁচামরিচের লাহান সোজা থন বাকা করি হালাইবো।’
লেখক -নাট্যকার-ফিল্মমেকার
সুত্র-মানবজমিন