নিজের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে ও পরিবারের হাল ধরতে গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালানো শুরু করেন হৃদয়। কিন্তু তার সে ইচ্ছে পূরণ হয়নি। এর আগেই নিভে যায় জীবন প্রদীপ। ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর বিজয় মিছিলে গেলে পুলিশ তাকে গুলি করে বলে দাবি পরিবারের। সে ঘটনার ভিডিও ফুটেজ থাকলেও মরদেহের খোঁজ পায়নি পরিবার।
পরিবারের অভিযোগ, হৃদয়ের মরদেহ গুম করা হয়েছে। হৃদয়ের জন্য এক বছর ধরে গুমরে কাঁদছেন তার পরিবারের সদস্যরা। মরদেহের সন্ধানে আছেন তারা। হৃদয়ের কবর কোথায়, কীভাবে হয়েছে সে খোঁজও জানতে চান তারা।
গত ৫ আগস্ট গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে কলেজছাত্র মোহাম্মদ হৃদয় (২০) শহীদ হন। হৃদয়ের বাড়ি টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার আলমনগর ইউনিয়নের আলমনগর মধ্যপাড়া গ্রামে। ওই গ্রামের ভ্যানচালক লাল মিয়া ও রেহেনা বেগম দম্পত্তির ছেলে। হৃদয় গোপালপুর উপজেলার হেমনগর ডিগ্রি কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।
এদিকে জুলাই যোদ্ধাদের গেজেট প্রকাশ হলেও সেই তালিকায় স্থান হয়নি হৃদয়ের। পরিবারের দাবি, গত ৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন হৃদয়।
এদিকে গত ১৬ জুলাই ছিল জুলাই শহীদ দিবস। সেই দিবস স্মরণে টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলা প্রশাসন উপজেলা পরিষদ হল রুমে আয়োজন করে দোয়া, সংবর্ধনা ও আলোচনা সভা। সেই অনুষ্ঠানে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও হৃদয়ের পরিবারকে ডাকা হয়নি। সরকার ঘোষিত দিবসে উপজেলা প্রশাসন শহীদ পরিবারকে আমন্ত্রণ না জানানোয় সবাই বিস্মিত হয়েছেন। হৃদয়ের পরিবারের সদস্যরা উপজেলা প্রশাসনের এমন আচরণের নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়েছেন।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, গত বছরের শুরুর দিকে নিজের পড়াশোনার খরচ ও সংসারের হাল ধরতে প্রথমে অটোরিকশা চালানোর জন্য গাজীপুরে যান। গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে অটোরিকশা চালাতে শুরু করেন হৃদয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ওইদিন বিকেলে বিজয় মিছিল বের হয় গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে। সেই বিজয় মিছিলে অংশ নেন হৃদয়। মিছিলে পুলিশ টিয়ারশেল ও গুলি করলে সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পুলিশ হৃদয়কে ধরে গুলি করলে মারা যাওয়ার পর টেনেহিঁচড়ে একটি গলিতে নিয়ে যান পুলিশ সদস্যরা। হৃদয়কে পুলিশ গুলি করে মারার সেই দৃশ্য আশপাশের লোকজন ভিডিও ধারণ করেন। সেই ধারণকৃত ভিডিও দেখে স্বজনরা শনাক্ত করেছে গুলিবিদ্ধ মরদেহটি হৃদয়ের। তবে তার মরদেহ কোথায় রেখেছে পুলিশ তা এখনও সন্ধান পাওয়া যায়নি।
পরিবারের সদস্যরা বলেন, হৃদয়ের দুইবোনের অনেক আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। তার বাবা লাল মিয়া এলাকায় ভ্যান চালাতেন। তবে অসুস্থ থাকার কারণে কয়েকমাস ধরে তিনি আর ভ্যান চালাতে পারেনি। এই অবস্থায় নিজের পড়াশোনার খরচ ও সংসার চালানোর জন্য কাজের সন্ধানে গাজীপুরের কোনাবাড়ী যান হৃদয়। পরে সেখানে একটি অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে চালাতেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, হৃদয় বাড়ির একটি জরাজীর্ণ ঘরে থাকতেন। তার বোন জামাইয়ের দেওয়া একটি ঘরের একপাশে থাকেন মা-বাবা। সেই ঘরেই নিহত হৃদয়ের জামা-কাপড় ও বিভিন্ন জিনিসপত্র রয়েছে। প্রতিদিনই ওই বাড়িতে লোকজন ভিড় করছেন।
চব্বিশের ৫ আগস্ট বিকেলে কোনাবাড়ীর কাশেমপুর সড়কের মেট্রো থানার শরীফ মেডিকেলের সামনে আনন্দ মিছিল বের হয়। সেই মিছিলে গিয়েছিলেন হৃদয়। এসময় পুলিশ মিছিলে গুলি ছোড়ে। ভয়ে হৃদয় একটি বাড়ির পাশে লুকিয়ে ছিল। সেখান থেকে পুলিশ তাকে ধরে সড়কে নিয়ে যায় ও মারধর করে। পরে হঠাৎই তাকে পুলিশ গুলি করে মেরে ফেলে বলে দাবি করেন স্বজনরা। এরপর আর তার মরদেহ মর্গেসহ বিভিন্নস্থানে খুঁজে পাননি স্বজনরা।
ওইদিন আশপাশের বাসা থেকে ধারণ করা কয়েকটি ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এতে দেখা যায়, ১০-১২ জনের পুলিশ সদস্য এক যুবককে ধরে সড়কের ওপর নিয়ে লাঠিচার্জ করছেন। এরপর তাকে চর্তুদিকে ঘিরে মারধর করছেন। এরমধ্যে হঠাৎ করেই একজন পুলিশ সদস্য যুবককে সামনা-সামনি গুলি করেন। এতে মুহূর্তে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। পরে পুলিশ সদস্যরা সেখান থেকে চলে যান। এরপর আবার দুইজন পুলিশ সদস্য যুবকের দুই হাত অপর দুইজন দুই পা ধরে তাকে নিয়ে যাচ্ছেন।

আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, দুইজন পুলিশের পোশাক পরা ও একজন কালো পোশাকধারী তাকে টেনেহিঁচড়ে একটি গলির ভেতর নিয়ে যাচ্ছেন। এসময় আশপাশে প্রচণ্ড গুলির শব্দ শোনা যায়। এরপর ওই তিনজন তার মরদেহ ফেলে চলে যান। এর একটু পর আবার দুইজন এসে তার মরদেহ গলির ভেতর নিয়ে যাচ্ছেন।
হৃদয়ের বোন জামাই ইব্রাহিম হোসেন বলেন, আমরা দুজন এক সঙ্গে গাজীপুরে বাসা ভাড়া করে থাকতাম। ৫ আগস্ট কারফিউ থাকায় আমরা রিকশা চালাতে পারিনি। সরকার পতনের খবর পেয়ে কোনবাড়ীতে আমি বিজয় মিছিলে অংশ নেই। তার কিছুকক্ষণ পরে হৃদয় কোনবাড়ীতে বিজয় মিছিলে অংশ নেয়। এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি ও টিয়ারশেল ছুড়তে থাকে। পরে আমি কোনাবাড়ী থানা সংলগ্ন একটি বাসায় আশ্রয় নিই। ওই বাসার গেট থেকে শুনতে চাই কয়েকজন পুলিশ সদস্য একজনকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। পরে আমি গেট থেকে বের হয়ে পোশাক দেখে হৃদয়কে চিনতে পারি। আমি গুলির ভয়ে সেখানে এগিয়ে যেতে পারিনি। ওই দিন মধ্যরাতেই হৃদয়ের মরদেহ গুম করা হয়েছে। ঘটনার পর হৃদয়ের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পরে থানা ও হাসপাতালের মর্গেসহ বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করেও হৃদয়ের কোনো সন্ধান পাইনি। পরে সিসি ক্যামেরা ও ভিডিও দেখে হৃদয়কে গুলি করার দৃশ্য এবং মরদেহ কীভাবে নিয়ে গেছে তা দেখতে পাই।
তিনি আরও বলেন, গত বছরের রমজানের পর থেকে হৃদয় সংসারের হাল ও পড়ালেখা খরচ চালানোর জন্য গাজীপুরে থেকে অটোরিকশা চালাতে শুরু করেন। এক বছর হলেও হৃদয়ের কোনো সন্ধান পাইনি। গাজীপুরের ডিবি পুলিশ একাধিকবার আমাদের সঙ্গে কথা বললেও মরদেহের কোনো সন্ধান দিতে পারেনি তারা। তালিকায় নামও উঠেনি হৃদয়ের। ঘটনাস্থল থেকে তার পরনের লুঙ্গি পাওয়া গেলে নিশ্চিত হয় যে নিহত যুবক হৃদয় ও তার মরদেহ গুম করা হয়েছে। আমরা এর সঠিক বিচার চাই।
হৃদয়ের বোন জিয়াসমিন আক্তার বলেন, আমার ভাইয়ের মরদেহ এখনো পেলাম না। মামলা করেছি তাও ঠিক মতো তদন্ত হচ্ছে না। আমার স্বামীর সঙ্গে হৃদয় অটোরিকশা চালাতো। হৃদয় নিজের খরচ চালাতো, বাড়িতে টাকাও পাঠাতো। ফোনে ঘটনার দিন বিকেলে হৃদয়ের সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয়েছে। হৃদয়কে বলেছি তুমি নিরাপদে থেকে বাসায় ফিরে যাও। পরে হৃদয় আমাকে বলে ‘তোমার সাথে রাতে কথা বলবো।’ এর প্রায় আধাঘণ্টা পরই আমার স্বামী ফোনে জানালো আমার ভাই বেঁচে নেই।
তিনি আরও বলেন, মরদেহ তো দূরের কথা, ঠিক মতো তদন্তও হচ্ছে না। ভাইয়ের আশা ছিল লেখাপড়া করে চাকরি করবে। বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটাবে। এখন পর্যন্ত আমার ভাইয়ের নাম গেজেটভুক্ত করা হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকেও তেমন সহযোগিতা পাইনি।
হৃদয়ের মা রেহেনা বেগম বলেন, সরকার ঠিকমতো তদন্ত করছে না। আমাদেরও খোঁজ খবর নিচ্ছে না। আমার ছেলেকে পাওয়ার আশায় এখনো অপেক্ষা করছি। শুধু বলে আসামি ধরেছি, কিন্ত আসামি ধরে কি করছে তারা? আমার ছেলে দেশের জন্য জীবন দিয়েছে কিন্তু শহীদের স্বীকৃতি মেলেনি। এক বছর হলেও আমার ছেলের মরদেহ এখনো পাইনি। ছেলের মরদেহ কোথায় আছে কেউ বলতে পারছে না।
তিনি আরও বলেন, কিস্তি করে আমার ছেলেকে গাড়ি কিনে দিয়েছি। সেই কিস্তির টাকা কে দেবে? আমার বাবাকে মাইরা ফেলেছে পুলিশ, গুলি করে মেরে ফেলেছে। আমার ছেলে বেঁচে থাকলে আমাদের কোনো চিন্তা ছিল না। তার ইচ্ছে ছিল নিজের লেখা পড়ার খরচ চালাবে, আমাদের সংসারের যাবতীয় খরচ বহন করবে। সরকার ও কোনো দল থেকে তেমন সহযোগিতা পাইনি। আমার ছেলেকে যারা হত্যা করেছে তাদের বিচার চাই।
হৃদয়ের বাবা লাল মিয়া বলেন, লেখাপড়ার খরচ দিতে না পারায় গাজীপুরে গিয়ে অটো চালাতো হৃদয়। ওইদিন আমাকে ৩ হাজার টাকা দিতে চেয়েছিলো। আমি টাকা না নিয়ে ঠিক মতো বাড়িতে আসতে বলেছিলাম। আমার মেয়ের জামাইয়ের সঙ্গে সকালে আসতে চেয়েছিল। তার আগেই বিকেলে পুলিশ সদস্যরা ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে।
এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেলার সাবেক আহ্বায়ক আল আমিন বলেন, বিষয়টি আমরা প্রশাসনকে জানিয়েছি। তার মরদেহের সন্ধান আমরা কেউ জানি না। সন্ধান বের করা হলো এখন মূল কাজ। প্রশাসনের কাছে জোর দাবি করছি হৃদয়ের সন্ধান বের করা হোক।
এ বিষয়ে গোপালপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তুহিন হোসেন সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আব্দুল্যাহ আল মামুন বলেন, হৃদয়ের পরিবারে সঙ্গে আমাদের একাধিকবার কথা হয়েছে ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। উনাদের গাজীপুর প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।