নিজস্ব প্রতিনিধিঃ টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়ে বেরিবাইদের মৃদুল নকরেক (৫০) ও থলেন নকরেক (৫৮) সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী। তাদের সংসারে দুই ছেলে ও তিন মেয়ে। ছোট ছেলে ছাড়া সবাইকে বিয়ে দিয়ে তারা নির্ভার। তবে অবস্থানগত কারণে তারা সন্তানদের থেকে পৃথক। স্বামী-স্ত্রী ও এক সন্তান মিলে এখন তাদের তিন সদস্যের সংসার।
সংসারের খরচের জন্য অন্যের কাজ করেন দু’জনেই। কিন্তু স্ত্রী মৃদুল স্বামীর সমান কাজ করেও বেতন পান স্বামী থলেনের চেয়ে ২০০ বা ২৫০ টাকা কম। দিনভিত্তিক চুক্তি হলে থলেন ৪০০-৫০০ টাকা পান। মৃদুল ২০০ বা ৩০০ টাকা নিয়ে বাড়ি ফেরেন। এ দিয়েই কোনোরকম চলে যায় তাদের সংসার।
নির্মলা নকরেকের বয়স ৫৫ বছর। তাঁর বাড়ি গারোপল্লির মধুপুরের সাইনামারী গ্রামে।
প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে কাঁচি, ছেনি, দা, কোদাল নিয়ে পুরুষের মতো কাজের সন্ধানে বের হন তিনি। একই সঙ্গে পুরুষও কাজ করেন। সেখানে পুরুষের মজুরি ৫০০ টাকা আর তাঁর মজুরি ২৫০ বা ৩০০ টাকা।
শুধু মৃদুল, নির্মলা নন– প্রেণিতা নকরেক (৪৫), লাবণী চিরান (৩০), সোমা মৃ (৪৫), রাজঘাটি গ্রামের চন্দ্রা নকরেক (৫০), ববিতা নকরেক (৩৫), সেলিনা দালবত (৪৮) সবার বেলায় প্রায় একই গল্প।
মধুপুর উপজেলার গড়াঞ্চলের আদিবাসী গারো অধ্যুষিত সব এলাকাতেই চোখে পড়ে নারী-পুরুষ মিলে কাজ করার দৃশ্য।
প্রসঙ্গত, মধুপুর গড় এলাকা চাপাইদ, সাইনামারী, নয়নপুর, কোনাবাড়ী, ধরাটি, মমিনপুর, দোখলা, পীরগাছা, বেদুরিয়া, কাকড়াগুনি, জালাবাদা, জয়নাগাছা, গায়রা, জাঙ্গালিয়া, বেরিবাইদ, মাগন্তিনগর, গেৎচুয়া, টেলকিসহ প্রায় ৫০টি গ্রামে গারো কোচ নারীরা কৃষিকাজে দিনমজুরের কাজ করে থাকেন।
মজুরি কম পাওয়ার কষ্টের মধ্যেও জীবন-জীবিকার জন্য কাকডাকা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাড়ভাঙা শ্রম দিয়ে এলাকার কৃষিকে তারা অনন্য করে তুলছেন।
কৃষি ও কৃষকের ভাগ্য বদলালেও তাদের ভাগ্য পরিবর্তন হচ্ছে না। গুছিয়ে না বলতে পারলেও তাদের অব্যক্ত আকাঙ্ক্ষা শ্রমকে মূল্যায়ন ও তার ন্যায্য মজুরি পাওয়ার। বৈষম্যের কারণে তারা সামাজিক মর্যাদাও কম পাচ্ছেন।
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮(২) অনুচ্ছেদসহ ৯টি অনুচ্ছেদে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের সুস্পষ্ট বিধান থাকলেও মানা হয় না।
আদিবাসী নারী শ্রমিকদের ভাষ্যমতে, মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় গারো নারীরাই সংসারের প্রধান বলে সংসারের প্রধান কাজগুলো তারাই করে থাকেন। ঘরে-বাইরের সব কাজে তাদের পদচারণা। কৃষিকাজে ব্যাপক শ্রম-ঘাম দিয়ে থাকেন তারা। সমানতালে পুরুষের সঙ্গে কাজ করেন।
ধান কাটা, চারা রোপণ, জমি নিড়ানি, ফসল কাটা, কলাবাগানের পরিচর্যা, হলুদ-আদা উত্তোলন, আনারস বাগানে কাজসহ গৃহস্থালির নানা কাজে তাদের উপস্থিতি।
বাগানে কাজ করার সময় পাওয়া গেল উল্লিখিত গারো নারী শ্রমিকদের। তাদের সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে আসে সংসারের সুখ-দুঃখের নানা কাহিনি।
মজুরি বৈষম্যের ব্যাপারে নির্মলা জানান, নারী বলে তাদের বেতন কম। কাজ সমান করলেও বেতন সমান দেওয়া হয় না। স্বামী, দুই ছেলে ও মেয়ে নিয়ে লোপিয়া ম্রংয়ের (৩৫) সংসার। তিনি মজুরি ভিত্তিতে মাঠে দিনমজুরের কাজ করেন।
তাঁর মজুরি দৈনিক ৩০০ টাকা। স্বামীর মজুরি ৪০০-৫০০ টাকা। দু’জনে যে মজুরি পান, তা দিয়ে কোনো রকমে সংসার চলে।
অভাবের সংসার বলে নিত্যদিন কাজ করতে হয়। কাজ না করলে খাদ্যের জোগান হয় না। নারী হওয়ার কারণে মজুরি বৈষম্য তিনি মেনে নিয়েছেন। ক্ষেতের মালিকরাও নারী হওয়ার কারণে মজুরি কমের কথা স্বীকার করেছেন।
পীরগাছা কোচপল্লির সুমিত্রা রানী কোচ (৪৮) ধানের জমিতে নিড়ানির কাজের ফাঁকে বলেন, অন্যের কাজ করেন। স্বামী-স্ত্রী দু’জনে মিলে কাজ করেও ঊর্ধ্বমূল্যের বাজারে তাদের হিমশিম খেতে হয়।
রূপালী রানী (৪০) জানান, ছেলেমেয়েদের যাতে এ কাজ না করতে হয় সেজন্য পড়াশোনায় দিয়েছেন। শত কষ্টেও প্রতিদিন মাঠে ছোটেন কাজের সন্ধানে। মজুরি ছাড়া যখন চুক্তির ভিত্তিতে কাজ করেন, তখন তারা পুরুষের সমান মজুরি পান। তবে চুক্তিভিত্তিক কাজের সুযোগ কম। ফলে তাদের দৈনিক মজুরিতে কাজ করতে হয়।