নিজস্ব প্রতিনিধিঃ স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত প্রথম মন্ত্রীসভা থেকে শুরু করে খোন্দকার মোশতাক, জিয়াউর রহমান, আব্দুস সাত্তার, এইচ এম এরশাদ, বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার পর্যন্ত সবকটি মন্ত্রীসভাতেই টাঙ্গাইল জেলার প্রতিনিধিত্ব রয়েছে।
একাদশ জাতীয় সংসদে টাঙ্গাইল জেলা থেকে মন্ত্রীসভায় সর্বশেষ পূর্ণমন্ত্রী ছিলেন টাঙ্গাইল-১ (মধুপুর-ধনবাড়ী) আসনের পাঁচবারের সংসদ সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারে টাঙ্গাইল-৬ (নাগরপুর-দেলদুয়ার) আসনের দুইবারের সংসদ সদস্য আহসানুল ইসলাম টিটু বানিজ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন।
টাঙ্গাইল জেলার রয়েছে সমৃদ্ধ রাজনৈতিক ইতিহাস। অনেক বরেণ্য রাজনীতিকের স্মৃতিধন্য এ জেলা। দেশ স্বাধীনের ৫২ বছরে ৭ জন রাষ্ট্র প্রধানের নেতৃত্বে মন্ত্রীসভাগুলো গঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ১২ বার সরকার গঠিত হয়।
সেই সবগুলো সরকারের মন্ত্রীসভায় টাঙ্গাইল জেলার মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর স্থান রয়েছে। দেশের সবগুলো মন্ত্রীসভায় টাঙ্গাইল জেলার ১১ জন পূর্ণমন্ত্রী, ৮ জন প্রতিমন্ত্রী ও ২ জন উপমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন।
সবমিলিয়ে ২১ জন মন্ত্রী টাঙ্গাইল জেলার হয়ে বিভিন্ন সময়ে গঠিত সরকারগুলোতে দায়িত্ব পালন করেছেন।
বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রীসভায় স্বরাষ্ট্র ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান টাঙ্গাইল-৫ (সদর-দেলদুয়ার) আসনের প্রয়াত জননেতা আব্দুল মান্নান।
এরপর খোন্দকার মোশতাকের মন্ত্রীসভাতেও ছিলেন তিনি। ওই সময় আব্দুল মান্নান ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মন্ত্রীসভাতেও টাঙ্গাইলের দাপট লক্ষ্য করা যায়। টাঙ্গাইল-৫ (সদর-দেলদুয়ার) আসনের আব্দুর রহমান গণপূর্ত ও ধর্ম মন্ত্রী এবং টাঙ্গাইল-৬ (নাগরপুর) আসনে নূর মোহাম্মদ সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান।
আব্দুস সাত্তারের মন্ত্রীসভাতেও এ দু’জনকে মন্ত্রী করা হয়।
এইচ এম এরশাদ সরকারের দীর্ঘ ৯ বছরে মন্ত্রী পরিষদে স্বরাষ্ট্র ও গণপূর্ত মন্ত্রীর দায়িত্ব পান টাঙ্গাইল-৫ (সদর-দেলদুয়ার) আসনে মেজর জেনারেল (অব:) মাহমুদুল হাসান।
এ সময় সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী ছিলেন টাঙ্গাইল-৬ (নাগরপুর) আসনে নূর মোহাম্মদ খান। আর পররাষ্ট্র উপমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন টাঙ্গাইল-৮ (বাসাইল-সখীপুর) আসনে ওয়াজেদ আলী খান পন্নী।
তীব্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালে সাধারণ নির্বাচনের পরে জাতীয় সংসদের ৫ম আইনসভা অধিবেশনে খালেদা জিয়ার প্রথম মন্ত্রীসভা গঠিত হয়।
বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি সরকার গঠন করলে টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনের এমপি লুৎফুর রহমান খান আজাদ ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
এই মন্ত্রীসভা ১৯৯৬ সালের জানুয়ারি মাসে বিলুপ্ত হয়।
এরপর ১৯৯৬ সালের (১৫ ফেব্রুয়ারি) ভোটারবিহীন চরম বিতর্কিত ৬ষ্ঠ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ওই নির্বাচন বাতিল হয়ে যায়।
এরপর ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের পর জাতীয় সংসদের সপ্তম আইন-সভার অধিবেশনে প্রথম শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন মন্ত্রীসভার সরকার গঠিত হয়।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে টাঙ্গাইল-১ (মধুপুর-ধনবাড়ী) আসনের এমপি আবুল হাসান চৌধুরীকে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০০১ সালের (১৫ জুলাই) তারিখে সেই মন্ত্রীসভার সমাপ্তি হয়।
২০০১ সালের (১ অক্টোবর) দেশে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার গঠন করে। পরে (১০ অক্টোবর) খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী করে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়।
বিএনপি সরকার গঠন করলে টাঙ্গাইলের রাজনীতিকদের জন্য মন্ত্রীত্বের ভাগ্য আরো বড় সুপ্রসন্ন হয়। এ সময় একজন পূর্ণমন্ত্রী, দুইজন প্রতিমন্ত্রী ও একজন উপমন্ত্রী হন।
টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসনের এমপি শাহজাহান সিরাজ বস্ত্র, পরিবেশ ও বন মন্ত্রী। টাঙ্গাইল-৬ (নাগরপুর-দেলদুয়ার) আসনের এমপি গৌতম চক্রবর্তী পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী। টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনের এমপি লুৎফর রহমান খান আজাদ বিভিন্ন সময়ে বস্ত্র ও পাট, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান, শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। টাঙ্গাইল-২ (ভূঞাপুর-গোপালপুর) আসনের এমপি আব্দুস সালাম পিন্টু বিভিন্ন সময়ে শিক্ষা, শিল্প এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
বিগত ২০০৬ সালের (২৯ অক্টোবর) এই মন্ত্রীসভা বিলুপ্ত হয়ে যায়।
গত ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর জাতীয় সংসদের নবম আইন-সভা অধিবেশনে (৬ জানুয়ারি), ২০০৯-এ দ্বিতীয়বার শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন মন্ত্রীসভা সরকার গঠিত হয়।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের মেয়াদেও মন্ত্রীত্ব বঞ্চিত হয়নি টাঙ্গাইল জেলা।
এ সময় টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসনের এমপি লতিফ সিদ্দিকী বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী এবং টাঙ্গাইল-১ (মধুপুর-ধনবাড়ী) আসনের এমপি ড. আব্দুর রাজ্জাক খাদ্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এ সরকারের বিলুপ্তি হয় ২০১৪ সালে।
বিগত ২০১৪ সালের (৫ জানুয়ারি) বিএনপিবিহীন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করলে মন্ত্রী পরিষদে টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসনের এমপি লতিফ সিদ্দিকীকে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
কিন্তু নিউইর্য়কের একটি অনুষ্ঠানে লতিফ সিদ্দিকী হজ ও তাবলিগ জামাত নিয়ে কটূক্তি করে চরম বিতর্কিত হয়ে উঠেন। গোটা দেশ তার বিচারের দাবিতে ফুঁসে উঠে। তারই ফলস্বরূপ তাকে মন্ত্রীসভা থেকে অপসারণ ও দলীয় পদ বহিষ্কার করা হয়।
পবিত্র হজ ও তাবলিগ জামাত নিয়ে কটূক্তিপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ায় সেই মন্ত্রীসভা থেকে তিনি অপসারিত হন।
এছাড়া টাঙ্গাইল-৬ (নাগরপুর-দেলদুয়ার) আসনে টেকনোক্র্যাট কোঠায় তারানা হালিম ২০১৩ সালে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন।
এরপর বিগত ২০১৮ সালের (৩০ ডিসেম্বর) দেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
বিগত ২০১৯ সালের (৩ জানুয়ারি) নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা বাংলাদেশ সরকারের আইন প্রণেতা হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। এরপর (৭ জানুয়ারি) শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত নতুন মন্ত্রীসভার সদস্যরা শপথ নেন।
ওই মন্ত্রীসভায় টাঙ্গাইল-১ (মধুপুর-ধনবাড়ী) আসনের এমপি ড. আব্দুর রাজ্জাক কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এছাড়া টাঙ্গাইল-৬ (নাগরপুর-দেলদুয়ার) আসনে সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য হিসেবে তারানা হালিম প্রথম নির্বাচিত হয়ে ২০১৮ সালে তথ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন।
সর্বশেষ ২০২৪ সালের (৭ জানুয়ারি) বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর (৯ জানুয়ারি) নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা বাংলাদেশ সরকারের আইন প্রণেতা হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
এরপর (১১ জানুয়ারি) শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত নতুন মন্ত্রীসভার সদস্যরা শপথ নেন। ওই মন্ত্রীসভায় টাঙ্গাইল-৬ (নাগরপুর-দেলদুয়ার) আসনের দুইবারের এমপি আহসানুল ইসলাম টিটু বানিজ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন।