মধুপুরের প্রথম অনলাইন সংবাদপত্র

বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৪১ অপরাহ্ন

First Online Newspaper in Madhupur

শিরোনাম :
টাংগাইলে সব ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে সম্প্রীতি র‌্যালি টাংগাইলে বাজার ব্যবস্থা তদারকি করছে পুলিশ প্রশাসন কালিহাতীতে প্লাস্টিকের বস্তায় চাল মজুদ করায় জরিমানা তারেক রহমানকে মিথ্যা মামলায় সাজা দেয়া ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায় হবে থাকবে– হযরত আলী মিঞা আগরতলায় সহকারী হাইকমিশনে হামলার প্রতিবাদে টাংগাইলে মশাল মিছিল গোপালপুরে সার্ভেয়ারের উপর হামলা টাংগাইলে সরকারের খাদ্য কর্মসূচির চাল ‘কালোবাজারে বিক্রি’র অভিযোগ সখীপুরে বনের জমি দখলের অভিযোগে জামায়াত নেতা গ্রেফতার ভূঞাপুরে বালু উত্তোলন বন্ধে অবরোধ তারেক রহমান ও সালাম পিন্টুসহ নেতৃবৃন্দ খালাস পাওয়ায় মির্জাপুরে বিএনপির আনন্দ মিছিল

টাঙ্গাইল শাড়ির খ্যাতি, বিবর্তন ও কৃতিত্বের ইতিহাস

সংবাদ দাতার নাম
  • প্রকাশের সময় : বুধবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪
  • ৫৮৪ বার পড়া হয়েছে

টাঙ্গাইল শাড়ির প্রাথমিক খ্যাতি এর সূক্ষ্ম বুনট ও মিহি বস্ত্রের কারণে। এজন্য সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব দাবি করতে পারে বসাক তাঁতিরা।

টাঙ্গাইলের বসাক তাঁতিরা আসলে ঢাকা থেকে দেশান্তরী হওয়া তাঁতি। তাদের মধ্যে প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে তারা ঢাকা—মূলত ধামরাই ও চৌহাট নামক স্থান থেকে টাঙ্গাইলে এসে নিবাস গড়ে তুলেছিল।

এ কথার সমর্থন মেলে বিশ শতকের প্রথমার্ধে ঢাকার বিশিষ্ট নাগরিক হাকিম হাবিবুর রহমানের প্রদত্ত বিবরণ থেকেও।

তিনি সূক্ষ্ম কাপড় উৎপাদনের সঙ্গে এর পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে লিখেছেন,

…কাগমারি পরগণা, যা পশ্চিম ময়মনসিংহের টাংগাইল মহাকুমার প্রসিদ্ধ জায়গা, সূক্ষ্ম কাপড় তৈরির ব্যাপারে প্রসিদ্ধি লাভ করে। এখানে এটা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে ঢাকা শহর থেকে ছয় মাইল পশ্চিমে তুরাগ নামে এক নদী প্রবাহিত রয়েছে, যা ময়মনসিংহ জেলার আলপসিং পরগণার যমুনা নদী থেকে উৎপন্ন হয়েছে এবং ঢাকার আটীর সামনে বুড়িগঙ্গায় এসে মিলিত হয়েছে।

এই নদীর বিশেষ বৈশিষ্ট্য এই যে এর তীর বরাবর বাংলার বড় বড় জমিদার, মুসলিম নেতাদের এবং কিছু হিন্দু ধনী পরিবারের অধিবাস রয়েছে।

আরো পড়ুনঃ টাঙ্গাইলের শাড়ীকে জিআই পণ্য ঘোষণা করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়

কাশিমপুরের রায়সাহেবরা, তালেবাবাদের সিদ্দিকী সাহেবগণ, সফরতলীর খান সাহেবরা (সম্ভবত শ্রীফলতলী), পাক আল্লাহ (পাকুল্লা) এবং দেলদুয়ারের সৈয়দ ও গযনবী বংশীয়রা, করটীয়ার পন্নীরা, যারা ইউসুফযায়ী পাঠানদের একটা শাখা, সন্তোষের রাজা সাহেবরা, সকলেরই এই নদীর তীরে বসবাস।

এঁরা ছাড়াও কিছু সম্ভ্রান্তজন ছিলেন যাঁরা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছেন। এঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই শিল্প ঢাকা থেকে স্থানান্তরিত হয়ে ওখানে পৌঁছেছে।

বিশিষ্ট গবেষক জোলেখা হক লিখেছেন,

“As mentioned before the homespun muslin thread was the domain of Hindu weavers of tantis, who, after the fall in the trade of fine muslin, gradually migrated from Dhaka to present-day Tangail and neighbouring Bajitpur, which also became famous as a center of fine cotton saris.” ২

এ দুই বিবরণের ভিত্তিতে বলা যায়, টাঙ্গাইলের তাঁতিদের উৎস হলো ঢাকার তাঁতি সম্প্রদায়। সে হিসেবে বলা যেতে পারে টাঙ্গাইলের তাঁতিরা মসলিন বয়নের কৌশল অনুসরণ করেই বস্ত্র বয়ন করত।

তবে কালের প্রবাহে নানা পরিবর্তনও এসেছে তাতে। যেমন অতীতে সনাতনী গর্ত তাঁত ব্যবহার করে বস্ত্র বয়ন করা হতো, যেখানে মাকু ছোড়া হতো হাতে। কালক্রমে সনাতনী গর্ত তাঁতের সংখ্যা কমে গেছে (এখন নেই বললেই চলে) এবং এর বিকল্প হিসেবে বর্তমানে খটখটি বা ঠকঠকি তাঁত, ফ্রেম তাঁত এমনকি চিত্তরঞ্জন তাঁত পর্যন্ত ব্যবহার হচ্ছে। আগে শুধু ঝাঁপের সাহায্যে হাতে নকশা বুটি তোলা হতো।

এখন জ্যাকার্ড ও ডবি ব্যবহার করে নানা ধরনের ডিজাইন করা হচ্ছে। বোধগম্য কারণে টাঙ্গাইলের বসাক তাঁতিদের বয়ন পদ্ধতি ও কৃৎকৌশলে নানা পরিবর্তন এসেছে।

টাঙ্গাইলের শাড়ির খ্যাতি নকশার কারণেই বিস্তার লাভ করেছিল। এবং এ খ্যাতি লাভের পেছনে মূলত দুটি কারণ সক্রিয় ছিল। প্রথমত, মসলিনের তাঁতি হওয়ায় তারা সূক্ষ্ম ও মিহি সুতা ব্যবহার করে উন্নতমানের বস্ত্র তৈরির কৌশল জানত। ফলে জোলা বা যোগীদের চেয়ে তাদের বস্ত্রের মান ভালো হতো।

বঙ্গীয় শিল্প বিভাগের প্রতিবেদনে (১৯২৯) স্পষ্টই বলা হচ্ছে, The popularity of these cloths is due to the fact that they are fine and look well. The Bajitpur weavers use 120 to 250 counts of yarn for fine cloths. ৩

দ্বিতীয়ত,

বিশ শতকের প্রথম দশকের মধ্যে নানা কারণে মসলিন বয়ন বন্ধ হয়ে গেলে টাঙ্গাইলের এ বসাক তাঁতিরা অতি দ্রুত পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছিল।

এর একটা হলো তৎকালীন আধুনিক প্রযুক্তি অর্থাৎ ঠকঠকি তাঁত ব্যবহার এবং ডবি ও জ্যাকার্ড মেশিনের ব্যবহার।

বিভিন্ন সূত্র থেকে যা জানা যায়, তাতে মনে হয় যে ১৯২০-১৯৩০ কালপর্বেই টাঙ্গাইলে ডবি ও জ্যাকার্ড মেশিনসহ ফ্লাইসেটেল বা ঠকঠকি তাঁতের প্রচলন হয়েছিল।

সাবুদ হিসেবে বলা যায়, টাঙ্গাইলে সরকারি বয়ন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে। ফলে ১৯২০-৩০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সেখানে ডবি ও জ্যাকার্ড চালু হয়ে যাওয়া খুবই সম্ভব।

বঙ্গীয় শিল্প বিভাগের কুটির শিল্পবিষয়ক জরিপ প্রতিবেদন (১৯২৯) এবং রঘুনাথ বসাক (১৯১৩-২০০৯) এর সাক্ষ্য এ বক্তব্য সমর্থন করে।

তার মানে অবশ্য এই নয় যে জ্যাকার্ড বা ডবি আসার আগে কাপড়ে কোনো নকশা ছিল না। তখনো নকশা হতো টাঙ্গাইলের শাড়িতে।

তবে এখন যেসব রকমারি নকশা দেখা যায় টাঙ্গাইল শাড়িতে, সে রকম নয়। ডবি বা জ্যাকার্ড মেশিন আসার আগে টাঙ্গাইলে কী ধরনের নকশা হতো, কীভাবে বোনা হতো সেসব নকশা, তার চমকপ্রদ বর্ণনা দিয়েছেন রঘুনাথ বসাক (১৯১৩-২০০৯) তার অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপিতে।

তার ভাষায় : “এরপর ১৩২৫ সনের পর হইতে ১৩৩৫ সন পৰ্য্যন্ত টাঙ্গাইল তাঁত বস্ত্র শিল্পের ক্রমে বৎসর পর বৎসর আরও উন্নতি লাভ করিতে লাগিল। এই সময়সীমার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য এই যে সাদা জমিনে তিন পাইড় অর্থাৎ পাছা পাইড় বলা হইত এগুলি প্রচুর তৈরি হইয়া বাজারে আদরের সহিত বিক্ৰী হইত। এই সময়ের কিছু কাল পূৰ্ব্ব হইতে কিছু কিছু নক্সীর কাজ আরম্ভ হইল যথা:- বেকী পাইড়, চোকবেকী, চাটাই পাইড়।

তৎপর বৎসর গুলিতে জরির, আর্ট সিল্ক রঙ্গীন সুতা ইত্যাদি ক্রমে আমদানী হইতে লাগিল উহা দ্বারা ১৩৩০ হইতে ক্রমে চেন পাইড়, বিস্কুট পাইড়, জরির বা শিল্কের চোচা পাইড় পটাপটি পটাপটি (সিতি সিন্দুর) পাইড়, তাজ পাইড়, আনারকলি পাইড়, চুরি পাইড়, স্কার্ট (?) পাইড়, ফিতাচুরি ফিতা বালেট পাইড়; এতদ্‌ব্যতীত আরো বিভিন্ন পাইরের নমুনার বস্ত্র তৈরি হইত।

কিন্তু এসব কাপড়ই সাদা জমিনে ছিল। ওপরোক্ত সাদা জমিনে লাল সাদা জমিনে পাছা পাইড় শাড়ী গুলি ১৩৩৫ সন হইতে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়।

তৎপর ১৩৩০ সনের পর হইতে ১৩৩৫ সন পর্যন্ত বয়ন শিল্পের আরও উন্নতি হয়। এ সময়ের মধ্যেও কোনো মেশিনের সাহায্য ছিল না। সবই হাত পা বাঁশ লোহার মাকুর সাহায্যে বস্ত্র তৈরী করিত।”

অবশ্য উল্লেখ করা যেতে পারে, বিশ শতকের বিশ কিংবা ত্রিশের দশকে ঠকঠকি তাঁত এবং ডবি ও জ্যাকার্ড মেশিন টাঙ্গাইল ছাড়াও আরো অনেক স্থানেই প্রচলিত হয়েছিল, তার পরও টাঙ্গাইলের শাড়ি বিশেষ খ্যাতি লাভের কারণ কী?

কারণ বসাক তাঁতিরা শুধু এটা ব্যবহার করেই থেমে থাকেনি। শাড়ির নকশায় নানা রকমের নতুনত্ব, পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন ইত্যাদির ব্যাপারে সচেষ্ট হয়েছিল। ফলে টাঙ্গাইলের শাড়ির নকশায় নানা রকম উন্নতি ঘটেছে। তবে এ উন্নতি একদিনে ঘটেনি।

রঘুনাথ বসাকের বিবরণ থেকে জানা যায়—

“তৎপর ১৩৩৫ সন হইতে জ্যাকার্ড মেশিন ও ফ্লাইসেটেলের সাহায্যে বসাক তাঁত শিল্পীদের উৎকৃষ্ট নমুনার বয়ন শিল্পের এক নবযুগ আরম্ভ হইল। টাঙ্গাইল নিবাসী মহাভারত বসাকের পুত্র রমেশ বসাক সৰ্ব্ব প্রথমে টাঙ্গাইলে ব্রিটিশ আমলের গভর্নমেন্ট উইভিং স্কুল হইতে জ্যাকার্ড মেশিনের ও ফ্লাইসেটেলের সাহায্যে বস্ত্র বয়ন করা শিক্ষা লাভ করে তথা হইতে উইভিং পাশ করে আসিয়া সে নিজ বাড়ীতে সৰ্ব্ব প্রথমে জ্যাকার্ড মেশিনে ও ফ্লাইসেটেলের একটি তাঁত বসাইয়া বিভিন্ন রকমের লতাপাতা নক্সী শাড়ী তৈরী আরম্ভ করে। ইহা দেখিয়া বিভিন্ন বসাকদের গ্রামের বসাকগণ ২/১টা করে জ্যাকার্ড মেশিনের তাঁত বসাইয়া লতাপাতার নক্সী শাড়ী তৈরী আরম্ভ করিতে লাগিল এবং এইরূপে ক্রমে ক্রমে প্রতি বসাকদের গ্রামে গ্রামে অল্প কয়েক বৎসরের মধ্যে প্রায় বসাকদের ঘরে ঘরে জ্যাকার্ড ও ফ্লাইসেটেলের সাহায্যে উৎকৃষ্ট বয়ন শিল্পের কাজ চালু হইয়া গিয়াছিল। এই প্রকারের ২/১ বৎসরের মধ্যে ১০০/১৫০ ডাঙ্গি জ্যাকার্ড মেশিনে বিভিন্ন নমুনার নক্সী লতাপাতা, জরি বা আর্ট শিল্পের শঙ্খ পাইড়, পাহাড় পাইড় বিশেষ উল্লেখযোগ্য।”

পরবর্তীকালে এ নকশার নানা পরিবর্তন ঘটেছিল।

এর বিবরণও রঘুনাথ দিয়েছেন—

“তৎপর ১৩৪০ সন হইতে ৫০/১০০/১৫০ /২০০/২৫০/৩০০ ডাঙ্গি জ্যাকার্ড মেশিনের সাহায্যে সাদা ও রঙ্গিন জমিনের মধ্যে শুধু মিহি সুতায়, হাফ সিল্ক, (হাওয়া শাড়ী) ফুল সিদ্ধ শাড়ীগুলির মধ্যে লাল জরি কম, সাদা জরির ও লাল জরি সংমিশ্রণে ১০০/১৫০/২০০/২৫০ ও ৩০০ ডাঙ্গি ইত্যাদি নানা প্রকার লতাপাতা ডিজাইনের মিনা পাইড় শাড়ী তৈরী হইতে লাগিল।

…এর ২/৩ বৎসর হইতে ঢাকা, কলিকাতা, বোম্বে ইত্যাদি বড় বড় সহর হইতে নূতন নমুনার ডিজাইন আনিয়া সুদক্ষ সুপার ফাইন্ বসাক তাঁত শিল্পীদের দ্বারা আরও অধিক উন্নত ধরনের শাড়ী তৈরী হইতে লাগিল। এই নমুনার শাড়ীগুলির আবার পৃথক পৃথক নাম রাখা হইয়াছিল যথা:- জরি ও সিল্কযুক্ত ‘মানে না মানা’, ‘মেট্রো’, ‘জয়হিন্দ’, ‘জর্জেট’, ইত্যাদি।…”

ফলে দেখা যাচ্ছে, বিশ শতকের প্রথমার্ধেই টাঙ্গাইল শাড়ির নকশায় বাইরের প্রভাব পড়েছিল।

এ ধারাবাহিকতা ১৯৪৭-এর দেশভাগের পরেও প্রবাহিত ছিল।

তবে টাঙ্গাইল শাড়ির নকশার আরেকটা পর্ব আছে, সেটার সূত্রপাত বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, বিশ শতকের আশির দশকে।

এর সঙ্গে টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরের কর্ণধার মুনিরা ইমদাদের বিশেষ ভূমিকা আছে। এছাড়া পরবর্তীকালের ঢাকার বুটিক হাউজগুলোর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।

ওপরের এ বিবরণ যদি আমরা গ্রহণ করি, তাহলে এখানে আমাদের যা বলার আছে তা হলো জামদানির মতো টাঙ্গাইলের সুতি শাড়ির নকশা প্রাচীন কোনো ঐতিহ্য বহন করে, এমনটা বলা ঠিক হবে না।

বরং ডবি ও জ্যাকার্ড মেশিন আসার পর টাঙ্গাইল শাড়ির নকশার গল্পটা মূলত আত্তীকরণের ও আত্মস্থকরণের গল্প। এবং এটা জামদানির মতো অতটা প্রাচীনও নয়। কিন্তু অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন হলেও টাঙ্গাইল শাড়ির নকশার বৈচিত্র্য কিন্তু কম আকর্ষণীয় নয়।

মজার তথ্য হলো, এ দুই ধারার শাড়ির নকশা কিন্তু একটা আরেকটাকে কখনো কখনো প্রভাবিত করেছে। জামদানি শাড়ির একটা নকশার নাম টাঙ্গাইল্যা পাইড়। আবার জামদানির ডিজাইন অনুসরণ করে জ্যাকার্ড মেশিনের সাহায্যে শাড়ি তৈরি হতে দেখা যায় টাঙ্গাইলে। টাঙ্গাইলের সে নকশার নাম জামদানি পাইড়।

ঠকঠকি তাঁত ও ডবি বা জ্যাকার্ড মেশিন আসার আগে টাঙ্গাইলের শাড়িতে যে ধরনের নকশা হতো, তা ছিল সাধারণ মানের। সে সময়ের তাঁতের কাজের বিবরণ দিয়েছেন রঘুনাথ বসাক এ ভাষায়।

তিনি বলেন, “তৎকালে বস্ত্র তৈরীর জন্য কোনো মেশিন ছিল না। শুধু হাত ও পা দ্বারা বাঁশ কাঠের সাহায্যে যন্ত্র তৈরী করিতে হইত। ফ্লাইসেটেল ছিল না। এক জোড়া ভালকাঠের দপ্তী দ্বারা, সুরু লোহার মাকুর দ্বারা, সুতার বওয়ের দ্বারা, ৮০০/৯০০/১,০০০/১১০০/১২০০/১৩০০ শানা দ্বারা, মাটী গর্ত করিয়া (পরীগাথ) তথায় বাঁশের রড় দ্বারা, পারাপারি দ্বারা সাদাসিদা ভাবে সব সাদা কাপড় তৈরী করিত। তখন এক ফর্দ রঙ্গিন শাড়ী ছিল না।

পরীগাথার গর্ভের মধ্যে পা দিয়া ঝাপ ধরিত আর দুই হাত দ্বারা লোহার চিকন মাকু ডাইন হাতের আঙ্গুল দ্বারা ধাক্কা দিয়া বাম হাতে লইত এবং আবার বাম হাতের আঙ্গুল দ্বারা ধাক্কা দিয়া ডাইন হাতে লইত। এইভাবে সমস্ত রকমের বস্ত্র তৈরী করিত।”

এ পদ্ধতিতে যেসব নকশা হতো, তা ছিল মূলত সরল ধরনের বিভিন্ন জ্যামিতিক নকশা। জটিল ও বাস্তবানুগ নকশা করার সুযোগ তাতে ছিল না।

কিন্তু ত্রিশের দশক নাগাদ (কিংবা তার কিছু আগেই) জ্যাকার্ড ও ডবি মেশিন এবং ফ্লাইসেটেল লুম চালু হওয়ার পরে বিভিন্ন ধরনের জটিল ও কঠিন ডিজাইন শাড়িতে ফুটিয়ে তোলায় আর অসুবিধা রইল না।

ফলে যেসব বিষয়বস্তু বা মোটিফ নকশায় চলে এল, তা মূলত বিভিন্ন প্রাকৃতিক অনুষঙ্গ। বিভিন্ন ধরনের ফুল, লতাপাতাসহ নানা ধরনের পাখি, প্রজাপতি, ময়ূর ইত্যাদি।

এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন, টাঙ্গাইল শাড়িতে ডিজাইন হয় এখনো দুভাবে। আদি পদ্ধতি অনুযায়ী এখনো কিছু শাড়িতে হাতে বুটি তোলা হয় জমিনে। এগুলোয় পাইড়ে জ্যামিতিক ধরনের সাধারণ নকশা থাকে কিংবা কোনো নকশাই থাকে না।

আর কোনো কোনোটায় শাড়ির পাইড়, আঁচল ও জমিনে জ্যাকার্ড মেশিনের সাহায্যে বুটি তোলা হয়। হাতে নিয়ে কাছ থেকে খেয়াল করলে বোঝা সম্ভব, বুটি হাতে তোলা নাকি জ্যাকার্ডে তোলা। হাতে তোলা বুটিগুলোর দুই পাশ অসম হয় কিন্তু জ্যাকার্ডের বুটিগুলো দুই পাশ সমান।

আবার কখনো কখনো রাজনৈতিক মোটিফ যেমন ‘নৌকা’ ব্যবহার করে শাড়ির পাইড় নকশা করার কথাও শোনা যায়। সত্তরের দশকে ও মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে এ শাড়ির পাইড়ে নৌকার নকশা খুব জনপ্রিয় ছিল।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশী তাঁতের প্রতি বাঙালি জাতির যে আগ্রহ ও মমত্ববোধ তৈরি হয়, তাতে টাঙ্গাইলের তাঁতিরা উপকৃত হয় এং শাড়ির নকশায়ও এর প্রভাব পড়ে।

এ সময় থেকে টাঙ্গাইলের শাড়ির নকশা আরো জটিল ও সমৃদ্ধ হতে থাকে।

তবে সাম্প্রতিককালের টাঙ্গাইল শাড়ির নকশার কৃৎকৌশলগত নতুন সংযোজন হিসেবে বলতে হয় কম্পিউটার ব্যবহারের কথা।

আগে জ্যাকার্ড মেশিনের জন্য গ্রাফ কাগজে নকশা আঁকা হতো, এখন এর বিকল্প হিসেবে নকশা করতে কম্পিউটারের সাহায্য নেয়া হয়।

জ্যাকার্ড মেশিনে নকশা করার একটা সুবিধা এই যে যেকোনো ধরনের নকশা শাড়িতে ফুটিয়ে তোলা যায়। এর মূল বিষয়টি নির্ভর করে জ্যাকার্ড মেশিন বয়নের জন্য প্রস্তুত করার ওপর।

বয়নকারী তাঁতি বা কারিগরের ওপর নকশা নির্ভর করে না, যেমনটা করে জামদানির ক্ষেত্রে। এ বিপুল স্বাধীনতা নানা রকম চিত্তাকর্ষক নতুনত্বের পাশাপাশি বিচিত্র (!) অভিজ্ঞতার জন্ম দিয়েছে নকশার ক্ষেত্রে।

যেমন সরেজমিন অনুসন্ধান করার সময় আমরা মোবাইল ফোনের টাওয়ার, সেলফোন, এমনকি হেলিকপ্টার পর্যন্ত টাঙ্গাইল শাড়ির নকশায় মোটিফ হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত হতে দেখেছি।

এ ধরনের নতুনত্ব বা নবতর সংযোজন ভালো না খারাপ, সে বিতর্কে না জড়িয়েও আমরা বলতে পারি এটাই টাঙ্গাইল শাড়ির নকশার বৈশিষ্ট্য। এ বৈশিষ্ট্য যতটা না ঐতিহ্যমুখী, তার চেয়ে অনেক বেশি বাস্তবমুখী ও সাম্প্রতিক ধারাপ্রবণ।

এর ফল হয়েছে এই যে টাঙ্গাইল শাড়ির নকশা সবসময়ই পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে গেছে ও যাচ্ছে। কোনো একটা বিশেষ ঘরানার দ্বারা টাঙ্গাইল শাড়ির নকশা প্রভাবিত হয়নি। বরং বিভিন্ন ধরনের নকশার ধারা এসে টাঙ্গাইল শাড়ির নকশায় মিশে গেছে।

আর বসাক তাঁতিদের হাতেও কোনো নতুন নকশা তৈরি হয়নি, তাইবা আমরা জোর গলায় কীভাবে বলি? কিন্তু নকশার নিদর্শন ও নির্ভরযোগ্য সূত্রের অভাবে এ সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো মন্তব্য করা দুরূহ।

আরো পড়ুনঃ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপতরের গাফিলতিতেই টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই সনদ হাতছাড়া

উল্লেখ্য, পুরনো দিনের টাঙ্গাইল শাড়ির হদিস পাওয়া এখন খুবই মুশকিল। বাংলাদেশের কোনো জাদুঘরে পুরনো টাঙ্গাইলের শাড়ি সংগৃহীত আছে বলে আমার জানা নেই।

আর ব্যক্তিগত সংগ্রহের শাড়িগুলোও নানা কারণে নষ্ট হয়ে বা হারিয়ে গেছে কিংবা সেগুলো খুঁজে বের করা কঠিন। ফলে পুরনো দিনের টাঙ্গাইল শাড়ির নকশা সম্পর্কে বিভিন্ন সূত্র (মৌখিক ও লিখিত) থেকে যতটুকু জানা গেছে, নিদর্শনের অভাবে তার সত্য-মিথ্যা যাচাই করা মুশকিল।

আর তাছাড়া আজও টাঙ্গাইলের তাঁত ও তাঁতি নিয়ে নানা রকমের নৃতাত্ত্বিক বা উন্নয়নমূলক গবেষণা হলেও টাঙ্গাইল শাড়ির নকশা নিয়ে বিশেষ কোনো গবেষণা হয়েছে বলে শোনা যায় না।

কিংবা এর কোনো যথাযথ ডকুমেন্টেশন করা হয়েছে বলে আমার জানা নেই।

টীকা

১. হাকিম হাবিবুর রহমান, ঢাকা: পঞ্চাশ বছর আগে, অনুবাদ: ড. মোহাম্মদ রেজাউল করিম, প্যাপিরাস, ঢাকা, ২০০৫ (প্র. প্র. ১৯৪৯), পৃ. ২৮

২. Zulekha Haque, ‘Sari: Cotton and Silk’, Textile Traditions of Bangladesh, National Crafts Council of Bangladesh, Dhaka, 2006, p. 68

৩. Government of Bengal, Department of Industries, Report on the survey of Cottage Industries in Bengal, Bengal Secretariat Book Depot, Calcutta, Second Edition: 1929, p. 79

৪. ঐ, পৃ. ৭৯-৮০। রঘুনাথ বসাকের অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি।

৫. রঘুনাথ বসাকের অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি।

৬. রঘুনাথ বসাকের অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি। ১৯২৮ সাল থেকে টাঙ্গাইলে ফ্লাইসেটেল লুমের প্রচলনের এ বিবরণের সমর্থনে কুটিরশিল্প বিভাগের জরিপের তথ্য উল্লেখ করা যায়। সেখানে বলা হচ্ছে, ‘In many places in the interior of Tangail subdivision fly-shuttle looms have been introduced by the peripatetic weaving instructor. (Report on the survey of Cottage Industries in Bengal, p. 80)

৭. রঘুনাথ বসাকের অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি

৮. রঘুনাথ বসাকের অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি

[রচনাটি দেশাল প্রকাশিত লেখকের ’বাংলাদেশের তাঁতশিল্প’ গ্রন্থ (২০১৮) থেকে ঈষৎ সম্পাদিত রূপে এখানে সংকলিত]

লেখক: শাওন আকন্দ (চিত্রশিল্পী ও গবেষক)

সংবাদ টি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

The Trend (Online Shop)

©2024 All rights reserved
Design by: POPULAR HOST BD
themesba-lates1749691102
Verified by MonsterInsights