হাবিবুর রহমানঃ মাটির প্রেম। অকৃত্রিম ভালোবাসা হৃদয় জুড়ে। প্রকৃতির সাথে নিবিড় যোগাযোগ। নিরাপদ, নির্ভেজাল, মুক্ত পরিবেশের নিত্য ভাবনা। প্রতিবেশের প্রতি দরদ। নিরাপদ ফসলের টানে শেকড়ের সাথে মাটির ঋদ্ধতা। সবুজ ঘাসে শিশির জমানো টবটব ঝরা দৃশ্য যার ভালোলাগা। সবুজ ঘাস-গাছে প্রকৃতির মেলবন্ধন। সবুজাভ প্রকৃতি জীব বৈচিত্র্য মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষা প্রাণ বৈচিত্র্য সবুজ আচ্ছাদন।
মাটির আর মানুষ প্রেম যাকে আপ্লূত করে তিনি হলেন কৃষক কামাল। কৃষক কামাল হচ্ছে টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার ফুলবাগ চালা ইউনিয়নের বুড়াকুড়ি নিভৃত গ্রামের এক নিরাপদ চাষাবাদের কৃষক। কৃষক কামাল শোলাকুড়ির সাবেক ইউপি সদস্য লস্কর আলী ছেলে। ৫ ভাই-বোনের মধ্যে কৃষক কামাল তৃতীয়। তিনি লেখালেখি করেন। কবিতাও লেখেন। কবিতা আর চাষাবাদের বিষয়বস্তু একই। ভিন্নতা অভিন্ন যেন তার নিত্য ভাবনা। যে রকম কবিতায়, তেমনি আবাদ ফসলে। তার উপজীব্য মাটি প্রকৃতি প্রেম। মাটির টানে প্রকৃতির বুকে নিরাপদ ফসল। মাটির স্বাস্থ্য রক্ষার ক্ষেত্রেও পরিবেশ বান্ধব সুষম সার ব্যবহার। মাটির জীব অনুজীব পোকামাকড় রোগ বালাই সবই একই ধাচে। তার চিন্তা চেতনা বসবাস ভাবনার সাথে হুবহু মিল। তার এক খন্ড কৃষি রাজ্যের নাম দিয়েছেন নিঝুম পল্লী।
মধুপুর উপজেলা সদর থেকে নিঝুম পল্লী প্রায় ১৫ কি.মি দূরে। সরজমিনে যেতে সোজা পাকা সড়ক পীরগাছা। তারপর বাম দিকে সবুজের পথ ধরে বাইদ পাড়ি দিয়ে প্রায় ঘন্টাখানেক সময়। পথে যেতে কত ফসলের বৈচিত্র্য চোখে পড়ল। যেন চোখ জুড়ানো। পাকা ধরে বুড়াকুড়ি গ্রামে পৌঁছালাম। পিচঢালা থেকে মেঠো পথ ধরে নিঝুম পল্লীতে। মাটির ঘর চার দিকে বারান্দা। বারান্দায় অনেকগুলো দেশী ছাগল ঘুরছে। হাঁসের ঘাক ঘাক শব্দ কানে আসছে। কবুতরের উড়াউড়ি। বাকুম বাকুম ডাক। চারদিকে গাছপালা। ঘাসে আচ্ছাদিত পুরো আঙিনা। সামনে এগিয়ে দেখা যায় পুকুর। পুকুরে হাঁস পালনের ঘর। দারুন দৃশ্য। পাশেই রাবারের বন, সবুজ ধানের বাইদ চারপাশে সবুজ ফল ফসলের মাঠ।
২০ বিঘা জমির উপর নিঝুম পল্লী ঘুরে কথা হয় কৃষক কামালের সাথে। তিনি জানালেন, এক যুগ আগে তার বাবার দেয়া জমিতে করেছেন এ নিঝুম পল্লী। জমি বাটোয়ারা করার সময় কামাল তার বাবাকে বলেছিলেন যে জমিতে তার কম যাওয়া হয়েছিল সেটা জমিটা তাকে দেওয়ার জন্য। বাইদের পাড়ে নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশ। এমন জমিটাই কৃষক কামাল তার বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন। পল্লীর নামাটাও পেয়েছেন ভাব থেকে। ভাবতে ভাবতে এ নাম নিঝুম পল্লী। তার পল্লীতে মাছ, হাঁস, কবুতর, আনারস, ছাগল, গরু, মুরগী, কাসাবা ঘাস কোন কিছুতেই তিনি ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করেন না বলে জানালেন। তারমতে, একদম নিরাপদ পল্লী। ঘাসেও কোন রাসায়নিক দেন না। মাছেও কোন প্রকার বিষাক্ত খাবার দেন না। পেয়ারা পোকায় খাচ্ছে। তিনি জানালেন, পোকারও হক আছে খাবারে। দিনের বেলায় পাখির ডাক শোনা যায়। নির্জন নিরিবিলি। রাতের বেলায় বারান্দায় জোনাকিরা খেলা করে। শেয়ালেন ডাক শোনা যায়। দখিনা বাতাস ঘরে ঢুকে হুহু করে এটা তার খুব ভালো লাগে। তার ঘরে বসার আসবাবপত্র মাটির তৈরি। খাট, টেবিল, শোফাসেট সবই মাটি। তার মতে, মাটির দেহ মাটির ঘর। এজন্যই সব মাটির। গাছের প্রেম মায়া ভালোবাসা তাকে কাছে টানে। শেকড়ের টানে তার ছুটে চলা। পল্লীতে বসে বসে প্রকৃতি পরিবেশ নিয়ে কবিতা লেখেন। তিনি কবিও। প্রকৃতির ভাবনা তাকে তাড়িত করে।
তিনি জানলেন, তার নিঝুম পল্লীতে এখন তিন বিঘা কাসাবা, সাত বিঘা আনারস, ছয় বিঘা পুকুর, এক বিঘা লাউ, পল্লীর ঘর এক বিঘা, ধান দুই বিঘা, হাঁস একশ’ দেশী ছাগল বাইশটি, কবুতর চল্লিশটি, গাভী একটি রয়েছে। স্থানীয়রা জানালেন, তার কোন ফল ফসলে কোন ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করেন না। তার পুকুরের মাছের ও ফলের চাহিদা বেশি ও সুস্বাদু। আজমত আলী জানালেন, নিঝুম পল্লীতে অনেক লোক বেড়াতে আসে। স্থানীয়রা নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘুরে বেড়ায়। ঘুরতে আসা আজম জানালেন, নিঝুম পল্লীটি প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়া সুন্দর পরিবেশ। যে কারো ভালো লাগার কথা।
কৃষক কামালের মতে, শস্য চক্র মেনে ফসল চাষ করলে কোন বিষ লাগবে না। অসময়ে ফসল চাষ করলে বিষ দিতে হয়। এজন্য তিনি শস্য চক্র মেনে ফসল চাষের পরামর্শ দেন।
এ বিষয়ে মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাকুরা নাম্মী বলেন, তার এ অর্গানিক চাষ পদ্ধতি প্রশংনীয়। তার কৃষি কাজে যদি টেকনিক্যাল সার্পোট লাগে কৃষি বিভাগ দিবে বলে জানালেন এ কর্মকর্তা।